আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ—এই সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে যতটা নাটকীয়, বাস্তবে তা ছিল বহুদিনের প্রস্তুতির ফল। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার আশপাশের গোষ্ঠী একটা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে চলেছে, যার মূল লক্ষ্য একটাই: রাজনৈতিক ময়দান তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা। এর পথের একমাত্র বড় বাধা ছিল আওয়ামী লীগ, এবং এখন তারা সেই বাধাটাকেও সরিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা আদৌ আইন, ন্যায় বা বিচারপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হলো, নাকি একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় পরিচালিত রাজনৈতিক নিষ্পেষণ?
মুহাম্মদ ইউনূসের গত কয়েক মাসের বক্তব্য ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করলেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি বরাবরই দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় কথা বলেছেন। কখনও বলেছেন এ বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই, কখনও আবার বলেছেন বিচারিক প্রক্রিয়া চলবে। অথচ শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তটি এলো, তা কোনো বিচার শেষ হওয়ার পর নয়, বরং রাজনৈতিক চাপ, আলটিমেটাম এবং রাজপথের জমায়েতের মুখে। মূলত এনসিপির নেতৃত্বে কিছু গোষ্ঠী কয়েকদিন ধরে যেভাবে সরকারের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছিল, এই নিষিদ্ধকরণ সেই চাপেরই পরিণতি।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই ইউনূসই কিছুদিন আগেও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে আদালতেই বিচার হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আদালতের রায় ছাড়াই দলটিকে কার্যত রাজনৈতিক পরিসর থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। এ থেকেই বোঝা যায়, ইউনূসের সরকার আসলে নিজের কথার প্রতি আস্থাশীল নয়, বরং যাদের ইশারায় চলছে, তাদের সুবিধামতো কথা বদলাতে প্রস্তুত।
এখানে বিষয়টা শুধু আওয়ামী লীগকে ঘিরে নয়। বড় প্রশ্ন হলো, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি এখন একদল বেসামাল, জবাবদিহিহীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর খেয়ালখুশির হাতে? যে সরকার জনগণের ভোটে আসেনি, যে সরকারকে সাংবিধানিক কাঠামো ব্যাখ্যা করে ক্ষমতায় বৈধভাবে বসানো যায় না, সেই সরকার এখন ঠিক করে দিচ্ছে কে রাজনীতি করবে, কে করবে না। এমনকি জামায়াতের মতো দলকেও এক মাসে নিষিদ্ধ করে আবার বৈধ করা হয়েছে। অতএব আজ আওয়ামী লীগ, কাল কি তবে বিএনপি—এটাই এখন প্রশ্ন।
সরকার বলছে, এটি নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে জরুরি পদক্ষেপ। কিন্তু মূলত এটি একটি বিরাট প্রতিস্থাপন প্রকল্পের অংশ—একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা ভেঙে ফেলে একটি ‘নিরাপদ’, সুবিধাজনক ও অনুগত ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করা। যার মাথায় ইউনূস, আর আশপাশে তার কিছু আন্তর্জাতিক বন্ধু এবং দেশীয় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। তারা যে কাউকে ছাঁটাই করতে পারে, আবার প্রয়োজন হলে বৈধ করতেও পারে। তাদের কাছে গণতন্ত্র মানে নিছক প্রয়োজনীয়তার সরঞ্জাম।
এই বাস্তবতা স্বীকার না করলে আমরা বুঝতে পারব না, আজকের বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে। এখানে কোনো দল নিষিদ্ধ হওয়াই মূল বিষয় নয়, বরং যেভাবে, যে প্রক্রিয়ায় এবং যে অজুহাতে তা ঘটছে—তাই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এর কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি ‘সংস্কার’ আর ‘নিরপেক্ষতা’র মুখোশ পরে, এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন।