১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। এর পর দেশে এমন এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, যেখানে কেউ বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করার সাহস পেত না। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার সব প্রচেষ্টা করা হয়। নেতাকর্মীরা ছিল হতাশ এবং দিশাহীন। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের ঝুঁকি তুচ্ছ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নয়, বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ সেদিন নতুন প্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই দিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা বাঙালি জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দিশা হারায়। আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় একটি গোষ্ঠী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে এক নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির আস্ফালন শুরু হয় চতুর্দিকে। গণতন্ত্র দূরে থাক, সান্ধ্য আইনের ঘেরাটোপে কথা বলতেও ভয় পেত মানুষ। সেই অবরুদ্ধ দিনের অর্গল খুলে যাওয়ার দিন ১৯৮১ সালের ১৭ মে।
এ যেন অনেকটাই গ্রিক পুরাণের বীর প্রমিথিউসের গল্প নতুন করে ফিরে আসা। সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। অলিম্পাসের চূড়ায় জিউসসহ যেসব দেবতার বাস ছিল, তাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল টাইটানরা। কিন্তু দেবতাদের মতো অত ক্ষমতা না থাকায় যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতে হয়েছিল তাদের। পরাজিত টাইটানদের বন্দি করা হয়েছিল এমন এক জায়গায়, যেন তারা আর ফিরে আসতে না পারে। প্রমিথিউস ছিলেন এ রকম এক টাইটানের ছেলে। প্রমিথিউস আর তাঁর ভাই এপিমিথিউসকে বন্দি না করে জিউস তাঁর সঙ্গেই রেখেছিলেন। কিন্তু প্রমিথিউসের কোনো ইচ্ছা ছিল না অলিম্পাসে থাকার। তিনি তাঁর ভাইকে নিয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন।
তখন মানুষ সুখে ছিল না। প্রমিথিউসের মন খারাপ হলো। তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে মানুষের কাছে যদি আগুন থাকত, তাহলে তো এ রকম করে জীবন কাটাতে হতো না। অনেক চিন্তা করে প্রমিথিউস জিউসের কাছে গিয়ে মানুষের জন্য আগুন চাইলেন। কিন্তু জিউস স্রেফ না করে দিলেন। কারণ দেখালেন যে আগুন পেলে মানুষ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং একসময় তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে দাঁড়াবে। প্রমিথিউস দুঃখ পেলেও আর কিছু না বলে চলে এলেন। কিন্তু মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষকে তিনি আগুন এনে দেবেনই। এই ভেবে প্রমিথিউস একদিন রওনা হলেন পূর্ব দিকে, যেদিক দিয়ে সূর্য ওঠে। পূর্ব দিকের সর্বশেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি দেখলেন যে সূর্য তার সারা দিনের পথপরিক্রমার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তখনো পুরো তেজ নিয়ে জ্বলা শুরু করেনি। সুযোগ বুঝে প্রমিথিউস সূর্যের এক কোনা ভেঙে নিয়ে চলে এলেন।
মানুষের কাছে এসে তিনি আগুন ধরিয়ে দেখালেন। আগুন কিভাবে জ্বালাতে হয়, কিভাবে আগুন দিয়ে রান্না করে খেতে হয়, তা শেখালেন। এর পাশাপাশি চাষাবাদ, হাতিয়ার তৈরি থেকে আরো অনেক কিছু শিখিয়ে দিলেন। মানুষ স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার গুহা ছেড়ে বাইরে থাকা শুরু করল, ঘরবাড়ি বানানো শিখল। মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াল।
এই গল্পেরই পুনরাবৃত্তি যেন আমরা দেখতে পাই ১৯৮১ সালের ১৭ মে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে এ দেশের একদল মানুষ যেন নিজেদের দেবতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। যা কিছু ভালো, সব তাদের অবদান, এটাই ছিল একমাত্র প্রচার। গণতন্ত্রের আকাশ ঢেকে দেওয়া হয়েছিল সামরিকতন্ত্রের কালো মেঘ দিয়ে। সমাজের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেশ ও জাতিকে গ্রাস করেছিল একরাশ অন্ধকার। সে এক অবরুদ্ধ অবস্থা। সপরিবারে নিহত জাতির পিতা। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই। সেই দিকভ্রান্ত দিনে আলোকবর্তিকা নিয়ে তিনি পা রাখলেন সেই মাটিতে, যেখানে মিশে আছে তাঁর স্বজনের রক্ত। সেই দিনটি হচ্ছে ১৭ মে ১৯৮১। মানুষের প্রাণের আকুতি ভাগাভাগি করে দেওয়ার এই দিনটি বাঙালির কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার দিন আজ। উর্দিধারী শাসকগোষ্ঠীকে প্রবল ঝাঁকুনি দেওয়ার দিন ১৭ মে। সর্বস্বহারা এক নারী আজকের এই দিনে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর আত্মিক স্বজন। ১৯৮১ সালের আজকের এই দিনেই দীর্ঘ ছয় বছরের প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
সেদিন ঢাকার সব পথ মিশে গিয়েছিল বিমানবন্দর ও মানিক মিয়া এভিনিউয়ে। আসলে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছিল যে মানুষ, তারা বুঝেছিল তাদের ত্রাতা আসছেন। আসছেন সেই দিকনির্দেশক, যিনি মুক্তির অগ্রযাত্রায় আসন্ন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন। মানুষের অধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলনে নতুন গতি যে তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে নতুন করে সূচিত হবে, তা বুঝতে এ দেশের মানুষের একটুও সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর মতো উদারপ্রাণ, মহৎ মানুষকে হারিয়ে এ দেশের মানুষ তখন এমন কাউকে খুঁজছে, যাঁর ওপর শতভাগ নির্ভর করা যায়। মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবেই তাঁর ফিরে আসা এই মাটিতে।
প্রমিথিউস প্রকৃতির শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের অগ্রগতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দিয়েছেন আগুন এবং আশার উপহার। আশা মানুষকে একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম করতে সাহায্য করে। আগুন প্রযুক্তির উৎস হিসেবে সেই সংগ্রামে সাফল্যকে সম্ভব করে তোলে। বাংলাদেশ যে বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, তার শতভাগ কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছিল।
জনকল্যাণের ব্রত সাধনার মন্ত্রে নতুন দীক্ষা নিয়ে আজকের এই দিনে এক নিঃস্ব নারী পিতৃভূমিতে পা রেখেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তিনি একেবারেই একা নন। বাংলার মানুষ রয়েছে তাঁর পাশে। এরাই তাঁর আত্মার আত্মীয়।
রাজনীতি ও জনকল্যাণের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বহুবার হামলাও করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সেটি আবারও ষড়যন্ত্রকারীদের চক্ষুশূল হলো। আবারও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দেশছাড়া করা হলো। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৮১ সালের ১৭ মের মতো আবারও বীরদর্পে ফিরে আসবেন দেশের মাটিতে। সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে আবারও রক্তিম সূর্য উঠবে পূর্ব দিগন্তে।
লেখক: এম নজরুল ইসলাম
সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়াপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক