বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার এক সত্য সামনে এসেছে—স্বাধীনতার বিরোধীরা কখনোই দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় বিশ্বাস করেনি। ড. ইউনুস তারই এক রক্তাক্ত প্রমাণ। তিনি কখনো ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করেননি, কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও ছিলেন না। বরং ছদ্মবেশে, ‘উন্নয়ন-অর্থনীতি’র মুখোশ পরে একসময় বিশ্ব দরবারে গরীবের বন্ধু সেজে ঘুরে বেড়ালেও—আসলে তিনি ছিলেন গরিবের ঘাড়ে বসা এক নিপীড়ক সুদখোর, যিনি আজ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে নিষিদ্ধের খাঁচায় পুরে তার আসল রূপ দেখিয়েছেন।
ড. ইউনুসের রাজনীতি কখনোই এই মাটির মানুষের, এই দেশের আত্মত্যাগের সঙ্গে মিলে না। তিনি ৫২-কে ‘অতিরিক্ত আবেগ’ বলেছিলেন, ৭১-কে ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, মন্তব্য ও নীরবতা সবসময়ই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আজ সেই ইউনুস, যিনি নিজের ভাষায় বাঙালির ইতিহাসকে তুচ্ছ করেছেন, সেই তিনিই দেশের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক শক্তি—আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে বুঝিয়ে দিলেন: তাঁর আসল পরিচয় কখনোই ছিল না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের।
তিনি জানেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন। একদিকে শেখ মুজিবের উত্তরসূরিদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ধ্বংস করার চেষ্টা, অন্যদিকে তাঁর ক্ষমতালিপ্সার পথে সব বাধা দূর করা। আজকে যে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া, ইউটিউবে ভিডিও বানানো—এমনকি কমেন্ট করা নিয়েও সাধারণ মানুষকে কারাগারে পাঠাচ্ছেন, তা কোনো বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত নয়। এটি তাঁর বহুদিনের পরিকল্পনার অংশ—যেখানে আওয়ামী লীগের মতো জনগণনির্ভর শক্তিকে কণ্ঠরোধ করে একদলীয় নীরবতা চাপিয়ে দেওয়া হবে।
ড. ইউনুসের চরিত্র বুঝতে হলে শুধু আজকের নয়, তাকাতে হবে তাঁর অতীতের প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে—যেখানে বারবার ফুটে উঠেছে এক উচ্চাভিলাষী ষড়যন্ত্রকারীর প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করতে তিনি কোনোদিন জনগণের দ্বারে যাননি, যাননি কোনো নির্বাচনের মাঠে। বরং ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ‘জনশক্তি পার্টি’ গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। সেই দল ছিল সেনা-পৃষ্ঠপোষক, নির্বাচনের বাইরে বসে দেশ চালানোর নীলনকশার অংশ। জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তখন, যেমন করে ভবিষ্যতেও করবে।
কিন্তু হাল ছাড়েননি ইউনুস। তিনি জানতেন, গণভবনের চাবি গণভোটে পাওয়া যাবে না, পাবে ধূর্ত পরিকল্পনায়, আন্তর্জাতিক শক্তিকে ব্যবহার করে, এবং দেশের রাজনৈতিক ভিত ধ্বংস করে। তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভর এনজিও-সাম্রাজ্যকে ব্যবহার করেছেন দেশের রাজনীতিতে চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে। বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইড, সিআইএ-পৃষ্ঠপোষক অনেক সংগঠনের ছায়াতলে থেকে তিনি চেষ্টা করেছেন একটি ‘নির্বাচনবিহীন সরকার’ প্রজেক্ট বাস্তবায়নের—যার মূলে ছিল একটি আদর্শ-বিহীন, রাজনৈতিকভাবে নপুংসক বাংলাদেশ।
তার ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাও ছিল জনগণের মুক্তির বদলে দাসত্ব নিশ্চিত করার যন্ত্র। “গরিব মানুষ সাপ্তাহিক কিস্তিতে মরবে, আর ইউনুস প্রফেসর স্যুট পরে নোবেল প্রাইজ নিতে যাবে”—এটাই ছিল বাস্তবতা। অনেক গ্রামীণ নারীর আত্মহত্যা, বাড়িঘর বিক্রি, সন্তানদের স্কুল ছাড়িয়ে কিস্তি পরিশোধ—এসব ছিল ইউনুসের ‘সামাজিক ব্যবসা’র পেছনের নিষ্ঠুর গল্প। একদিকে আন্তর্জাতিক সেমিনারে ‘শান্তির ফেরিওয়ালা’ সাজা, অন্যদিকে দেশে কিস্তির চাপের জাঁতাকলে হাজারো পরিবার পিষ্ট—এ এক দ্বিচারিতা, যেটি কখনো আড়াল থাকেনি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো—ড. ইউনুস কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থরক্ষায় ছিলেন এক বিশ্বস্ত নাম। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ করেছিল, তখন ইউনুস ছিলেন সেই সিদ্ধান্তের নীরব বা উৎসাহদাতা। তাঁর নিজস্ব স্বার্থে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় তিনি দেশের একটি স্বপ্নের প্রকল্প আটকে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে সরকার ব্যর্থ হয়, আর তিনিও নিজের ‘অল্টারনেটিভ’ ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারেন।
তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ—সাংবিধানিক ক্ষমতা হরণ, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ, ডিজিটাল নজরদারি, গরিব শোষণ—সবই বলছে, এই মানুষটি গণতন্ত্রের নন, জনগণের নয়। তিনি আন্তর্জাতিক কর্পোরেট এজেন্ডার ধারক, যিনি চিরকাল বাংলার মাটি ও মানুষের ইতিহাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছেন।
ড. ইউনুসের পরিচয় যতটা না একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, তার চেয়েও বড় করে আজ উঠে এসেছে তাঁর অশুভ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ। ‘সামাজিক ব্যবসা’ আর ‘ক্ষুদ্রঋণের ফেরিওয়ালা’ নামে তিনি গরীব মানুষকে সুদের ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক দাতাদের পায়ের তলায় মাথা দিয়ে তিনি বাংলাদেশে এক ‘সফট উপনিবেশ’ কায়েম করতে চেয়েছিলেন। আজ সেই মানুষটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসেই জনগণের কণ্ঠ বন্ধ করতে, ডিজিটাল নজরদারির ফাঁদ পেতে মানুষের চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছেন।
আওয়ামী লীগ তাঁর চোখে যতটা না রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি আদর্শ—স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের, ও জাতীয়তাবাদের প্রতীক। এই আদর্শের বিরুদ্ধে ইউনুসের লড়াই নতুন কিছু নয়। তিনি স্বাধীনতার ইতিহাসকেই মুছে ফেলতে চান। তিনি চান এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ হবে, যেখানে শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ করলে সেটি হবে রাষ্ট্রদ্রোহ, আর যেকোনো দেশপ্রেমিক চিন্তাই ‘অপরাধ’।
ড. ইউনুস আজ প্রশাসনের মুখপাত্র নন, তিনি নিজেই প্রশাসন। তাঁর নির্দেশে পুলিশ কাজ করছে, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হচ্ছে, বিটিআরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি মুছে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি যন্ত্র এখন তাঁর হাতে—তাঁর একচ্ছত্র স্বৈরতন্ত্রের যাজক হিসেবে।
এই সেই ইউনুস, যিনি কোনো নির্বাচনে দাঁড়ানোর সাহস দেখাননি, জনগণের রায়ে আসার পথে কখনো বিশ্বাস রাখেননি, অথচ আজ তিনি জনগণের নির্বাচিত শক্তির কণ্ঠ চেপে ধরছেন। এই নির্লজ্জতা কেবল রাজনৈতিক অপকর্ম নয়, এটি একটি জাতির আত্মাকে পদদলিত করার নাম।
এখন সময় ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেওয়ার—ড. ইউনুস কখনো এই দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র বা প্রগতির পক্ষে ছিলেন না। তিনি ছিলেন, আছেন, এবং থাকবেন—বাঙালির চেতনাবিরোধী প্রতিপক্ষ। আজ তিনি যে কণ্ঠরোধের খেলা শুরু করেছেন, সেটি শেষ পর্যন্ত তিনিই টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। কারণ ইতিহাসের রায় ধীর হলেও নিশ্চিত, আর স্বৈরতন্ত্রের পতন যত দেরিতেই হোক—তা অবশ্যম্ভাবী।