ঢাকা, ১৫ মে ২০২৫: বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে রাখাইনে “মানবিক করিডোর” ইস্যুতে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ১১ মে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের (এএফডি) প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসানকে অপসারণের চেষ্টা করেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস সরকারী প্রজ্ঞাপন আটকে রেখেছেন।
নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, মানবিক করিডোরের বিরোধিতা করায় পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে। জসিম উদ্দিন এই ইস্যুতে সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অংশের সঙ্গে একমত ছিলেন। তবে তাকে একটি ক্লাবের বিল সংক্রান্ত অজুহাতে অপসারণ করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, যিনি মার্কিন নাগরিক, এই করিডোরের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। সূত্র জানায়, ইউনূস ও খলিলুর রহমান জসিম উদ্দিনের অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
ইউনুস ও খলিলুরের এই পক্ষটা চায়, যেভাবেই হোক হুবহু মার্কিন প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ি রাখাইনে মানবিক করিডোর দিতে, কিন্তু পররাষ্ট্র সচিব ও জেনারেল ওয়াকার বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থ সবার আগে নিশ্চিত করতে চায়, এখানেই দ্বন্দের সুত্রপাত।
অন্তর্বর্তী সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও এই করিডোরের বিরোধিতা করছেন, কারণ এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তা ও সর্বভৌমত্ব রক্ষায় “মানবিক করিডোর”এর বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান সেনাবাহিনীর অফিসারদের। সূত্র জানায়, বেশিরভাগ জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের পক্ষে।
এদিকে, খলিলুর রহমান মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের মধ্যস্থতায় ও সমন্বয়ে সেনাসদর কর্তৃক বরখাস্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসানকে পদ হারানো থেকে আপাতত রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
তবে শেষ মুহুর্তে প্রাপ্ত তথ্যসুত্রে জানা গেছে, পিএসও কামরুল হাসান, যিনি মানবিক করিডোরের নন লিথাল পণ্যর আসা যাওয়া পুরোটা নিয়ন্ত্রনের দায়িত্বে আছেন, তার উপস্থিতি কোন ভাবেই মেনে নিচ্ছে না ওয়াকার জামানের সমর্থিত অংশ। পিএসও কামরুল হাসান বরখাস্ত হলেও সরকারী প্রজ্ঞাপন না হওয়ায় উত্তেজনা বাড়ছে সেনাসদরে।
এদিকে নতুন পিএসও হিসাবে নাম শোনা যাচ্ছে ৯ম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঈন খান এর। আগামী সপ্তাহে এইসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারী হতে পারে।
মানবিক করিডোর বিরোধী গ্রুপ, যার মধ্যে জেনারেল জামানের নেতৃত্বাধীন দল রয়েছে, মনে করে যে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। তারা দাবি করছে, এই করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে মিয়ানমারের আরাকান আর্মি ও অন্যান্য পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসকে গোপনে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। এই বিরোধের জেরে জেনারেল জামানের ১১ মে থেকে ২৩ মে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল হয়েছে। তিনি হাওয়াইয়ের হনলুলুতে ল্যান্ড ফোর্সেস প্যাসিফিক (ল্যানপ্যাক) সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
অন্যদিকে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসান ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর একটি অংশ মনে করে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিলিটারি অপারেশন জোন (এমওজেড) হিসাবে ঘোষণা করা উচিত। এটি সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর ওপর চাপ কমাতে সহায়ক হবে। এই গ্রুপ ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বিজিবি-র ভূমিকা জোরদার করতে চায়।
এই ঘটনাবলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। সেনাবাহিনীর এই বিভক্তি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রভাব ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।