জুলাই-আগস্টে লালবিপ্লবীগণ যেরকম একটি ট্রাপে পড়েছিলেন, সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে আওয়ামী লীগারদের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগও একইরকম ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের দেশ চালানোয় অবশ্যই সমস্যা ছিলো। সে সমস্যাকে ইউনূস মেটিকুলাস ডিজাইনের মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক বড়ো করে প্রচার করেছিলো। বাংলাদেশের মতো ধান্দাবাজে ভর্তি গরীব দেশে মানুষের সমস্যার অন্ত নেই। তবে, যারা আসলে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভালো ছিলো, এমনকি তাদেরকেও দেখেছি পেটে গ্যাস জমলেও আওয়ামী লীগকে গালি দিতে। তারা ভেবেছিলো, না তারা আসলে কিছুই ভাবে নাই, তাদেরকে দিয়ে চাওয়ানো হয়েছিলো আওয়ামী লীগ সরকার পড়ে যাক। “পরেরটা পরে দেখা যাবে।” মূল সমস্যা এখানে। আসলে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে অবশ্যই পরেরটাও আগে ভাবতে হবে। তা নাহলে পরে গিয়ে ধোঁকা খেতে হবে। লালবিপ্লবীরা যেমন বড়ো ধরনের ধোঁকা খেয়েছে।
সেনাপ্রধান বলেছেন, রাখাইনে করিডোর দেয়ার এক্তিয়ার শুধুমাত্র নির্বাচিত সরকারের। এই কথা কেন বলেছেন, সেটা কি তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কারণে, নাকি রাশিয়া-চীন-ভারতের চাপে, নাকি আমেরিকার মেটিকুলাস ডিজাইনে এনসিপি/জামায়াত/বিএনপির মাধ্যমে করিডোর দিতে, নাকি আসলেই দেশপ্রেম থেকে, সেরকম অনেকগুলো সমীকরণ আছে। কার্যত আরাকান আর্মি এখনো বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পার্টি করছে এবং সে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটেছে বলে জানা নেই। সেন্টমার্টিন এখনো সর্বসাধারণের জন্য ওপেন হয় নাই। তবে এই বক্তব্যের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না।
একইভাবে সেনাপ্রধান বলেছেন, মবসন্ত্রাস কঠোর হাতে দমন করবেন। তার বক্তৃতার পরদিনই এমপি মমতাজের ওপর আদালতে হামলা হয়েছে। হামলা ঠেকানোর কোনো চেষ্টা করা হয় নাই। হামলাকারীকে গ্রেফতারও করা হয় নাই। ৫ই আগস্টে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, তিনি দেশের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন। তারপরের অবস্থা তো আমরা সবাই জানি। মোটামুটিভাবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানেই স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত সবকিছু গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্য ভাঙচুরের বাইরে আর কী পরিমাণ ধ্বংস করা হয়েছে, সেটি এখনই জানা যাবে না। ভবিষ্যতে বিরাট সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে জাতির সামনে। হয়তো কোনো নথিপত্রই আর আস্ত নেই। তারপরও যদি কেউ জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্যে আস্থা রাখতে চান, তাকে আটকাবো না।
তবে, আমার এই লেখার ফোকাস ওয়াকারের “ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে”, এই বক্তব্যে আওয়ামী লীগারদের উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাসের কারণ সহজেই বোধগম্য। বর্তমানে আওয়ামী লীগারদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। কার্যত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে তেমন কোনো বাঁধায় পড়েনি ইউনূস। আওয়ামী লীগারদের একটা অংশ মনে করছে যে নির্বাচন হলে লীগই জিতবে, তাদের সুদিন ফিরবে। আরেকটা অংশ মনে করছে যে বিএনপিও যদি নির্বাচনে জিতে, তাহলেও “রাজনৈতিক” সরকার থাকলে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে পারবে। এই ২ অংশের কোনো অংশই বিস্তারিত ভেবে দেখছে না আসলে পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে। অনেকটা সেই লাল বিপ্লবীদের “পরেরটা পরে দেখা যাবে”র মতো।
আমরা প্রথমেই দেখি, ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কোন কোন বাধা পার হতে হবে।
১) নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার:
আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে কার্যত একটি ‘নিষিদ্ধ’ দল। যেহেতু, নিবন্ধন বাতিলের ঝুকিতে আছে, সেহেতু নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এটা হলো সোজাসাপটা সত্য কথা। ওয়াকার বলে নি যে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিবে। অনেকে আশা করছেন আওয়ামী লীগকে বাইরে রাখলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হওয়া নিয়ে বিএনপি-জামায়াত-ইউনূসের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারত ছাড়া কেউ নেই এবং ভারতও এই ব্যাপারে চাপ দেয়ার মতো অবস্থায় নেই। সুতরাং, জেনারেল ওয়াকারের সেটআপে ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিবে, এরকম কোনো আশা আপনি এই মুহূর্তেই বাদ দিতে পারেন।
২) ইউনূসের অধীনে নির্বাচন:
মনে করেন, তারপরও কোনো মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ হিসেবে ইউনূস আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিলো। কিন্তু, আপনি নিশ্চিত থাকেন, খেলতে নিলেও ফাউল করে আওয়ামী লীগকে পঙ্গু বানিয়েই রাখা হবে। ফেয়ার ইলেকশন বলে কিছু হবে না। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলে আসছেন, ইউনূসের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। ইউনূসের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া মানে ইউনূসকে বৈধতা দেয়া। ইউনূস সংবিধানকে খুন করা লোক। সংবিধান অনুসারে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আজ হোক, কাল হোক, ১০ বছর পরে হোক, এই বিচার হবেই। তার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া মানে আওয়ামী লীগের আদর্শিক ও রাজনৈতিক মৃত্যু তরান্বিত করা।
৩) নির্বাচনে বিএনপির জয়:
কেন্দ্রে অবশ্যই ইউনূস এবং জামায়াতই মেটিকুলাস ষড়যন্ত্রের মূল বস। তারা শেষ মুহূর্তে বিএনপিকে অথর্ব মনে করে মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশীদারিত্ব থেকে মাইনাস করেছিলো। কিন্তু, তৃণমূল কি সেটা জানতো? বা এখনো জানে? না। তৃণমূলে বিএনপি মনে করে তারাই এখন ক্ষমতায়। তৃণমূলে ইউনূসের সমর্থন শূন্য, জামায়াত নগণ্য, তৃণমূলে আওয়ামী লীগারদের ওপর ৯০% অত্যাচারই চালিয়েছে বিএনপির লোকজন। তারা এই মুহূর্তে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। কিন্তু, যখনই নির্বাচনে জয়লাভ করবে, তখনই পুরো মাত্রায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। খুনি তারেক জিয়া তখন দেশে ফিরবে। “রাজনৈতিক সরকার”-এর সময়ে সুস্থ রাজনীতির আওয়ামী বাসনা কখনোই পূরন হবে না।
৪) নির্বাচনে এনসিপি, জামায়াতের জয়:
অনেকেই ভাববেন, এটি কীভাবে সম্ভব! বর্তমানে ইউনূস যে “সরকার” চালাচ্ছে, তা সম্ভব হয়েছে যেভাবে, এটিও সেভাবেই সম্ভব হতে পারে। আমেরিকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইউনূসের আর ২/৩ বছর সময় দরকার। এনসিপি-জামায়াতের বিজয় ইউনূসকে সেই সময়টা দিতে পারে। আওয়ামী লীগ যদি রাস্তায় না নামতে পারে, বিএনপিও রাস্তায় নামার সম্ভাবনা খুব কম। বিএনপি গত ১৫ বছর (লীগ সরকার) + ১ বছর (ইউনূস সরকার) যে কারণে রাস্তায় নেমে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারেনি, এনসিপি-জামায়াত জিতলে ঠিক একই কারণে জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। সুতরাং, সেনাবাহিনী এবং আমেরিকার ব্যাকিংয়ে এনসিপি সরকার অন্তত ২ বছর টিকে যাবে। তারপর নাহয় আগাম নির্বাচন দিয়ে সরে পড়লো। আওয়ামী লীগ এখন যেমন চিপায় আছে, সেই সরকারের সময়েও একইরকম থাকবে, যদি স্ট্রাটেজি চেঞ্জ না করে।
তাহলে, আওয়ামী লীগের করণীয় কী?
আওয়ামী লীগের প্রথম করণীয় হলো ভবিষ্যত সিনারিও নিয়ে চিন্তা করা। তারপর সেই অনুযায়ী স্ট্রাটেজি ঠিক করা। আওয়ামী লীগের মূল গোল হওয়া উচিত, ইউনূস যেভাবে জোর-জবরদস্তি করে আওয়ামী লীগকে কিকআউট করেছে, ঠিক একইভাবে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে ইউনূসকে উৎখাত করা। এই শক্তি হতে হবে গণতান্ত্রিক শক্তি। আওয়ামী লীগকে এই সত্য বিশ্বাস করতে হবে যে, তারাই এখনো বৈধ সরকার। তাদেরকে জোর করে উৎখাত করা হয়েছে। নিজেদের শক্তিতেই তাদেরকে ফিরতে হবে। আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে হবে। কোটি কোটি আওয়ামী লীগ কর্মী এখনো মাঠে নামতে ইচ্ছুক, তাদেরকে গাইড করার মতো নেতৃত্ব অনুপস্থিত। নেতৃত্বের সেক্টরটা ঠিক করে একটু সাহস করে নামলেই ইউনূস আরো নড়বড়ে হয়ে পালাতে বাধ্য হবে। তবে, এ কাজে অবশ্যই সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের সহযোগিতা লাগবে। সেনাবাহিনীকে নিউট্রাল অবস্থানে নিয়ে যেতে পারলেই যথেষ্ট, আওয়ামী লীগের পক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিলেও চলবে।
তবে, আমেরিকাকেও ম্যানেজ করতে হবে। ট্রাম্পের সাথে উইন-উইন ডিল অবশ্যই সম্ভব। ডিল কী হতে পারে, সেটি ভেবে দেখতে হবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরকেই। আমার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে “নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী” অবস্থানে আওয়ামী লীগ নেই। তবে শেখ হাসিনা অবশ্যই আমার চেয়ে অনেক ভালো বুঝেন, তিনি কোনো না কোনো ডিলের উপায় বের করতে পারবেন। এটা খুব বেশি কঠিন কাজ না।
একইসাথে রাজনীতির মাঠে বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে হবে, যাতে তাদের দিক থেকে খুব বেশি বাধার সম্মুখীন না হতে হয়। তবে এটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণও নয়। বিএনপির রাজনীতি এখনো লিপসার্ভিস দিয়েই চলছে। তৃণমূলে এরা একটু ঝামেলা করবে। তবে ইউনূসকে উৎখাত করে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে বসতে পারলেই বিএনপির তৃণমূল ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বিএনপি করা লোকজনের ডেমোগ্রাফি মাথায় রাখলেই বিষয়টা বুঝবেন। বিএনপির নেতাকর্মীরা শতভাগ সুবিধাবাদী। চালু। অবস্থা পক্ষে থাকলে এরা যেমন নিষ্ঠুর হয়ে যায়, তেমনিভাবে অবস্থা বেগতিক দেখলে এরা নিজেদের স্বার্থে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করবে। ১৫ বছর যেমন ছিলো। আওয়ামী লীগারদের পক্ষে ১৫ বছর দূরে থাক, ১৫ দিনও চুপ করে থাকা সম্ভব না।
ওয়াকারের এই বক্তব্যের পরেও আওয়ামী লীগের জন্য খেলার মাঠের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। দৃশ্যত ইউনূস একটু চাপে পড়েছে, এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। ইউনূস-ওয়াকারে যৌথ প্রযোজনায় একটি নাটকের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে বাইরে থেকে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে ইউনূস চাপে আছে, আওয়ামী লীগের কর্মীদের মনোবল বাড়ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা কি এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারবেন? সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলে ইতিহাস হবে, গৌরবের ইতিহাস। দেশ ধ্বংস করেছে ইউনূস। কিন্তু, সেই ধ্বংসের সাথে সাথে আওয়ামী লীগও ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। অপরাধের বিচার হবে। দেশ আবার গড়ার কাজটা শুরু করা যাবে।
।।এটিম, ফেইসবুক।।