উত্তরপূর্বে জেলা শহর রংপুর। উত্তর পশ্চিমে সৈয়দপুর থানা সদর। পশ্চিমে কাছাকাছি পার্বতীপুর। এরই মাঝে যমুনেশ্বরী নদী তীরে বদরগঞ্জ। রংপুরে রয়েছে পাকিস্তান আর্মির শক্তিশালী ক্যান্টনমেন্ট। সৈয়দপুরে আরেকটি ক্যান্টনমেন্ট, এ ছাড়া বিহারী অধ্যুষিত। বিহারী অধ্যুষিত পাশের পার্বতীপুরও।
সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩১ মার্চ রাতে বিদ্রোহ করে বাঙালী সৈন্যদের নিয়ে বের হয়ে আসেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্বরত ছিলেন মেজর নিজাম, লেঃ মোখলেস, সেকেন্ড লেঃ রফিক। সবাই নিজ নিজ সৈন্যদের নিয়ে জমায়েত হন ফুলবাড়িতে। এখানে বাহিনী পুনর্গঠিত হয়, ব্যাটেলিয়নের অধিনায়কত্ব গ্রহন করেন মেজর নিজাম।
নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে এক কোম্পানী সৈনিক সহ অবস্থান নিতে বলা হয় বদরগঞ্জে। উদ্দেশ্যে যমেনুশ্বরী পেরিয়ে রংপুর থেকে পাকিস্তান আর্মির আগমন ঠেকানো। বাকীরা ফুলবাড়ি ও আশেপাশে ডিফেন্স নিয়ে সৈয়দপুর থেকে পাকিস্তান আর্মির আক্রমন মোকাবেলা প্রস্তুত।
৭এপ্রিল ক্যাপ্টেন আনোয়ার বদরগঞ্জে ডিফেন্স নেন। ৯ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের ডিফেন্সের ওপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করেন ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালেক। ব্রিগেডিয়ারের বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেনের যুদ্ধ চলে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বাঙালী সৈনিকেরা পেছনে হটতে থাকে। এ সময় এক ডিফেন্স থেকে অন্য ডিফেন্সে যাওয়ার সময় বদরগঞ্জ বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘেরাওয়ে পড়ে যান অধিনায়ক আনোয়ার। তাঁর গাড়ির ড্রাইভার শহীদ হন। আনোয়ার গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে অন্যদিকে বদরগঞ্জ বাজারের ভেতরে ঢুকে পড়েন। বহু কষ্টে বের হয়ে বদরগঞ্জ রেলস্টেশন হয়ে আড়াই মাইল গ্রামের ভেতরে গিয়ে তাঁর সৈনিকদের দেখতে পান। তখন শরীর রক্তাক্ত এবং পা গুলিবিদ্ধ। সেখান থেকে তাঁকে ফুলবাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে সৈনিকেরা আবার এগিয়ে যায় বদরগঞ্জের কাছাকাছি রামনাথপুর ইউনিয়নের খোলাহাটিতে। ১০ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি বাহিনী খোলাহাটি আক্রমণ করে। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে টিকতে না পেরে সৈনিকেরা ফুলবাড়ীতে চলে আসে। এদিকে ক্যাপ্টেন আশরাফ ও লেফটেন্যান্ট মোখলেসের কোম্পানিও ফুলবাড়ীতে আসে।
১১ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ফুলবাড়ী আক্রমণ করে। ফুলবাড়ীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পুরো ব্যাটালিয়নের ভীষণ যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ব্যাটালিয়ন আরো পিছিয়ে চরখাইতে চলে যায়।
বাঙালী সৈনিকেরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান আর্মি পরিকল্পনা করে এই জনপদের বেসামরিক মানুষদের উপর প্রতিশোধ গ্রহনের। তাদের প্রতিশোধ স্পৃহায় সহায়তা করতে এগিয়ে আসে পার্বতীপুরের বিহারী নেতৃত্ব আর ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলার সভাপতি এটিএম আজহার।
১৭ এপ্রিল। দুপুর ১২টার দিকে বিহারী বাচ্চু খান ও কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মির একদল পার্বতীপুর থেকে ট্রেনে করে আসে বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের দিকে। অপরদিকে এটিএম আজহারের নেতৃত্বে আরেকদল সেনা আসে বদরগঞ্জ সদরের দিক থেকে। দুদিক থেকে এসে তারা ঘেরাও করে পুরো ইউনিয়নের সকল গ্রাম। অবরুদ্ধ গ্রামগুলো থেকে প্রাণ বাঁচাতে নারী,পুরুষ ও শিশুরা ছুটে যান ঝাড়ূয়ার বিল ও পদ্মপুকুর নামের জলাশয়ের দিকে। ঘাতক বাহিনী তাড়া করতে করতে সেখানে পৌঁছায় এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
হত্যাযজ্ঞ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় তারা ধরে নিয়ে যায় বাছাই করে আলাদা করা ২০০ তরুনদের। এঁদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বাকীদের খোঁজ মিলেনি আর।
বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মেছের উদ্দিনের মনে পড়ে, ধরে নেয়া তরুনদের মধ্যে তাঁর খালাতো ভাই সমবারুর লাশ পাওয়া গিয়েছিল। এই লাশ দেখার পর সমবারুর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন। একই দিন শহীদ হয়েছিলেন মেছের উদ্দিনের মামাতো ভাই ফজলুর রহমান, চাচাতো ভাই আজাদুল, ইসলাম উদ্দিন, আব্দুল গাফ্ফার প্রামাণিকের ৩ সন্তান ওহিদুল, ওমর আলী, রজব আলী, খিবীর উদ্দিনের ২ ছেলে নুর মোহাম্মদ, খায়রুল সহ আরো অনেকে।
সেসময় ১৭ বছরের তরুন মেছের উদ্দিন তাঁর পরিবারের সব সদস্য সহ আশ্রয় নিয়েছিলেন ঝাড়ুয়ার বিল পদ্মপুকুরে। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও অনেকের মৃত্যুদৃশ্য তাঁকে দেখতে হয় নিজ চোখে। সেদিন শহীদ হয়েছিলেন কমপক্ষে ১২০০ মানুষ।
এই হত্যাযজ্ঞের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মো. আফজাল হোসেন প্রামাণিকের মনে পড়ে, সেদিন হত্যা করা হয়েছিল বানিয়াপাড়ার মেনহাজুল বিএসসি ও হিন্দুপাড়ার প্রাণকৃষ্ণ স্যারকে। আর মনে পড়ে-
‘পথেঘাটে পড়েছিল লাশ। ছোপ ছোপ রক্তের ওপর পড়েছিল অনেকের অসার দেহ। বাড়িঘরগুলো জ্বলছিল। চারপাশে ছিল ভীতিকর পরিবেশ। ওইদিন রাজাকার বাচ্চু খান, কামরুজ্জামান ও আজহারের তাণ্ডবলীলায় লাল হয়ে গিয়েছিল ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুরের পানি।’
সুত্রঃ
===
১। তৎকালীন ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সাক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র নবম খন্ড
২। মেছের উদ্দিনের সাক্ষ্য। ১৭ মার্চ ২০১৪, দৈনিক প্রথম আলো।
৩। ঝাড়ুয়ার বিল গণহত্যা। ১০ জুন, ২০১৩। সালেক খোকন।