সাল ১৯৮১।জার্মানির একটি আদালতে চলছে বিচারকাজ। হঠাৎ এক নারী পকেট থেকে পিস্তল বের করে কোর্টের মধ্যেই গুলি করে বসেন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীকে।
তিন সন্তানের জননী ওই নারীর নাম মেরিয়ান বেচমেয়ার। তিনি শহরতলীর একটি ছোট্ট বাসায় একা একা থাকতেন মেয়ে এনাকে নিয়ে। অভাবের তাড়নায় অন্য দুই সন্তানকে দিয়েছিলেন দত্তক।
একদিন মেরিয়ান কি একটা কারণে এনাকে বকা দেন। রাগ করে বাড়ির বাইরে বেরোলে, এনা ফাঁদে পড়ে এক স্থানীয় এক লোকের। লোকটির নাম গ্রেবোস্কি, পেশায় কশাই। এর আগেও অল্পবয়সী মেয়েদের অ্যাবইউজ করার অভিযোগ ছিল গ্রেবোস্কির বিরুদ্ধে। এনার দিকে তার নজরও ছিল অনেক দিন ধরে।
সেদিন সুযোগ পেয়েই এনাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করে গ্রেবোস্কি। মৃতদেহ ফেলে দেয় পাশের একটি জলাশয়ে।
পুলিশ গ্রেবোস্কিকে গ্রেফতার করে কোর্টে সোপর্দ করে। কোর্টে এনাকে খুন করার বিষয়টি স্বীকার করে সে। স্বীকার না করে উপায়ও ছিল না, কারণ এনার গলায় গ্রেবোস্কির আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল।
খুনের কথা স্বীকার করলেও ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে গ্রেবোস্কি। উল্টো এনার উপর তাকে প্রলুদ্ধ করার ও তার কাছে টাকা চাওয়ার দোষ চাপিয়ে দেয় সে।
এই বিষয়গুলো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি এনার মা মেরিয়ান। সেই সময় ভিকটিমকে পরীক্ষার মাধ্যমে ধর্ষণ প্রমাণের মতো প্রযুক্তি আসেনি। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে বিচার প্রক্রিয়া। একদিকে মেয়ে হারানোর শোক, অন্যদিকে দিনের পর দিন কোর্টে ঘুরতে ঘুরতে একসময় হতাশ হয়ে পড়েন মেরিয়ান।
তখনকার দিনে জার্মানিতে ধর্ষণ করেও আসামীরা ছাড়া পেয়ে যেতে বিভিন্ন অজুহাতে। মেরিয়ানকে জেরার সময় এনার চরিত্রের উপর কালিমা লেপন করার চেষ্টা করেন আসামী পক্ষের আইনজীবী। মৃত মেয়ের প্রতি মিথ্যা অভিযোগ এবং বিচারের কোনো গতি না দেখে মেরিয়ান দিশেহারা হয়ে যান।
এক শুনানির দিন হঠাৎ করেই কোর্টের মধ্যে উঠে দাঁড়ান মেরিয়ান। পকেট থেকে পিস্তল বের করে পরপর আটবার গুলি করেন আসামীকে। সেখানেই মারা যায় ধর্ষক।
হত্যা করার পর মেরিয়ানের চোখে মুখে ছিল না কোনো ভয়ের ছাপ। মেরিয়ান বলেন, “আমি চেয়েছিলাম ওর মুখে আর পুরুষাঙ্গে গুলি করতে। যে পুরুষাঙ্গের সাহায্যে ও আমার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে আর যে মুখ দিয়ে কোর্টে ও আমার মেয়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। আমি আশা করছি আমার মেয়ের খুনী মারা গেছে।”
এই ঘটনার পর আলোড়ন ওঠে পুরো জার্মানি জুড়ে। পুলিশ মেরিয়ানকে আটক করলেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন আদর্শ মা। তাকে “রিভেঞ্জ মাদার” এর খেতাব দিয়েছিলেন দেশটির নাগরিকেরা।
মেরিয়ানের কাজ সাধারণ মানুষের কাছে প্রশংসিত হলেও আইনের চোখে সেটা ছিল এক ধরনের অপরাধ। মেরিয়ান যদি ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করেন সেটির এক ধরনের বিচার, আর যদি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কাজটি করেন তাহলে আরেক ধরনের বিচার।
তদন্ত দেখা যায় হত্যাকাণ্ডটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। গ্রেবোস্কিকে খুন করার জন্য মেরিয়ান পিস্তল সংগ্রহ করেন, এমনকি কয়েকদিন ধরে গুলি ছোঁড়ার ট্রেনিংও নেন।
শেষ পর্যন্ত আদালত মেরিয়ানকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়। রায় ঘোষণার পর পুরো জার্মানি জুড়ে শোরগোল ওঠে। মেরিয়ানের মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার জার্মান রাস্তায় নেমে আসে। চাপের মুখে ১৯৮৫ সালের জুন মাসে মেরিয়ানের সাজা অর্ধেক পূরণ হলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তির পর আরও ১১ বছর বেঁচে ছিলেন মেরিয়ান। ১৯৯৬ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সমাহিত করা হয় তার ছোট্ট মেয়ে এনার পাশে।
এত বছর পর আজও ঘটনাটি স্মরণীয় হয়ে গেছে জার্মানির ইতিহাসে। মেরিয়ান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন জার্মানির বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা। এরপর দেশটিতে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানো হয়। বর্তমান সময়ে জার্মানিতে কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করে অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, যা আসলে মেরিয়ানেরই অবদান।