বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক খাত, যা গত এক বছরে বহুমুখি সংকটে নিমজ্জিত। জাপানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক, ভারতের বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা এবং দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান শিল্পের টেকসই উন্নয়নকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে, যেখানে কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন এবং লাখো শ্রমিকের জীবিকা জড়িত।
তবে চলতি বছরের ১৭ই মে থেকে ভারত বাংলাদেশের পোশাকসহ কিছু পণ্যের স্থলবন্দরপথে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটি মূলত বাংলাদেশ কর্তৃক ভারতীয় সুতা আমদানিতে আরোপিত বিধিনিষেধের প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া পদক্ষেপ। এতে বাংলাদেশের ভারতের বাজারে রপ্তানির ৪২ শতাংশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীদের ব্যয়বহুল ও দীর্ঘসময়সাপেক্ষ সমুদ্রপথে রপ্তানি করতে বাধ্য করছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা ভবিষ্যতে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের সময় চালু হওয়া এ শুল্ককে মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত ‘অনৈতিক’ বলে রায় দিয়েছে, এখনো তা প্রত্যাহার করা হয়নি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “আমরা এখন একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপে রয়েছি। নীতিগত সহায়তার অভাব, উচ্চ সুদের হার, গ্যাস সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা শিল্পকে দুর্বল করে দিচ্ছে।”
টেক্সটাইল কারখানাগুলো গ্যাস সংকটে উৎপাদন সক্ষমতার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হারিয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং এনবিআরের কর্মকর্তাদের ধর্মঘট বাণিজ্যে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের পদক্ষেপ মূলত ঢাকা-দিল্লির রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রতিফলন। গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকেই উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে চির ধরেছে। এর ফলেই ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করেছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে পোশাক রপ্তানিতে।
বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান বলেন, “ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ হওয়ায় যেসব দেশে সরাসরি ফ্লাইট নেই, সেখানে রপ্তানি খরচ বেড়েছে এবং সময়ও লাগছে অনেক বেশি।”
বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারত হয়ে বাংলাদেশ ৩৬টি দেশে প্রায় ৩৪,৯০০ মেট্রিক টন পোশাক রপ্তানি করেছে, যার বাজারমূল্য ৪৬২.৩৪ মিলিয়ন ডলার।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও লাগাতার ধর্মঘট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। রাষ্ট্রীয় কর্মচারী থেকে শুরু করে পোশাকশ্রমিকরাও আন্দোলনে সরব, ফলে সরকারের দৃষ্টি মূলত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত, বাণিজ্যিক নীতিনির্ধারণে নয়। সরকার অনেক গার্মেন্টও বন্ধ করে দিয়েছে।
হাতেম বলেন, “উদ্যোক্তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে নতুন বাজার খুঁজছেন, পণ্যের মান ও বৈচিত্র্য বাড়াচ্ছেন। বিদেশি ক্রেতারাও আমাদের প্রতি আস্থা রাখছেন।”
তবে এই সাফল্যের আড়ালে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো চরম ক্ষতিগ্রস্ত। ফারুক হাসান বলেন, “এসএমই খাত যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে পুরো শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কারণ বড় কারখানাগুলোর ভিত্তি তৈরি হয় এদের মাধ্যমেই।”
এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের ২০২৫ সালের নভেম্বরে নির্ধারিত এলডিসি উত্তরণ পেছানোর দাবি জানিয়েছেন, যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা আরও কিছুদিন বজায় থাকে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তিন বছর, চীন দুই বছর এবং কানাডা ২০৩৪ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
সিপিডি’র বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এলডিসি উত্তর বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে দ্রুত এগোতে হবে।”