এই দেশে এখন একটা সংখ্যা দিয়ে সবকিছু মাপা যায় : তিন কোটি মানুষ—যারা খুব শিগগিরই চরম দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে যাবে। আরেকটা সংখ্যা মাথার মধ্যে গেঁথে রাখা উচিত : ১০ মাস ধরে ১০ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি। এক যুগ ধরে যারা শুধু দেখেছে উন্নয়নকে দৃশ্যমান হতে, পদ্মার উপরে ব্রীজ, কর্নফুলির নিচ দিয়ে টানেল, বিদ্যুতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা, মহাকাশে দেশের দীপ্ত পদচারণা, তারা এখন বাজারে গিয়ে এক কেজি ডাল না কিনেই ফিরে আসে।
যারা আজ দেশের অর্থনীতি চালাচ্ছে, তারা আসলে কী চালাচ্ছে? এটা কি একটা অর্থনীতি, নাকি ব্যর্থতার একটা দীর্ঘ লেজ টেনে নিয়ে যাওয়া? মানুষ যেখানে খেতে পাচ্ছে না, সেখানে তারা বাজেট নিয়ে ব্যস্ত, কোন আমলা কত ভাতা পাবে, তার হিসাব করছে। কৃষকের ভর্তুকি কাটা হচ্ছে, অথচ উপদেষ্টাদের গাড়ির বহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
একটা জিনিস খুব স্পষ্ট—এই অর্থনীতি মানুষ চালাচ্ছে না, এই অর্থনীতি মানুষকে চালাচ্ছে। আর সেই পথের শেষে আছে খালি থালা, খালি পকেট, আর চোখে অন্ধকার।
যে মোহাম্মদ ইউনুস নামধারী লোক ও তার কথিত ‘অ-সরকার’ আজ দেশের ঘাড়ে চেপে বসেছে, তারা উন্নয়ন বলতে বোঝে শুধু ব্রিফকেস ভর্তি ধান্দা। তারা বিনিয়োগের মৃত্যু দেখে না, কর্মসংস্থানের খরা দেখে না, গ্রাম থেকে শহরে এসে বেকার হয়ে ঘুরতে থাকা ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে না। তারা শুধু দেখে বিদেশ থেকে শিল্পীদের চামড়া চুঁয়ে পড়া আলোর ঝলকানি, বিদেশ থেকে আমদানি করা দামী মদিরায় চুমুক দিতে দিতে।
ব্যাংকিং খাত একেবারে দেউলিয়া। খেলাপি ঋণ আর চোরাচালান নিয়ে যারা প্রতিদিন মহড়া দেয়, তারা কোনো বিচার পায় না। বরং রাতের অন্ধকারে সাদা কালি দিয়ে রিপোর্ট মুছে দেওয়া হয়। যেসব ব্যাংক রাষ্ট্রের রক্তচোষা রূপ নিয়েছে, তাদের আজও “ব্যবস্থাপনা বোর্ড” আছে।
অর্থনীতির গায়ে ছোপ ছোপ পচন ধরেছে। জিডিপি নামছে, বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, সঞ্চয় কমছে, ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখছে না, বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, অথচ উপদেষ্টা-আমলা-মহাপরিচালকদের চকচকা ছবি ঠিকই আছে। সরকার নিজের খরচ কাটছে না, উল্টো জনগণের পকেট কেটে চলেছে।
একটা সময় ছিল, সরকার মানে একটা ছায়া—মানুষের উপর থাকা একটা নির্ভরতার নাম। আজ সেই সরকার মানে একটা শকুন—ঘাড়ে বসে মাংস ছিঁড়তে থাকা ক্ষমতার মুখ।
এই দেশের শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছে, নারীরা কাজ ছেড়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে, ব্যবসায়ী বিনিয়োগে ভয় পাচ্ছে। এই ভয় শুধু টাকাপয়সার না—এই ভয় আসলে একটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দেখার ভয়। এই ভয়ের উৎস দুর্নীতি না, বরং অব্যবস্থাপনা; এই ভয় আসে প্রতিদিনের অচলায়তনের মুখোমুখি হয়ে। প্রতিদিন যখন একটার পর একটা প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে, তখন বোঝা যায়—ক্ষমতায় থাকা মানুষেরা একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, যাদের দেশের মানুষ বা বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সত্যটা হচ্ছে, এই অর্থনীতি আর অর্থনীতি নেই—এটা একটা খাঁচা, যেখানে মানুষ বন্দি। সরকার বলছে, তারা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখবে—কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তারা শুধু হিসাব দিচ্ছে, দায় নিচ্ছে না। তারা জানে, এই মানুষেরা কাঁদে, কিন্তু দাঁড়ায় না। তারা কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু মেনে নেয়। সেই সুযোগেই তারা চালায় আরও এক ধাপ লুটপাট।
কিন্তু কাঁদা শেষ হলে মানুষ চুপ করে না—তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন এই সরকার তাই সেইদিনের জন্যই তার হাতে রেডি করে রাখছে ভয়, অস্ত্র আর মুখরোচক ভাষণ।
এই লেখার শেষে কোনো আহ্বান নেই। এই লেখা শুধু একটা কালেক্টিভ ক্ষোভ, যা জমে আছে কোটি মানুষের ভেতর। এই ক্ষোভ কোনোদিন চিৎকার হয়ে উঠবে কি না—তা জানি না।