* শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘সামার টাইম’* শ্রেষ্ঠ পরিচালক সৃজিত মুখার্জি * শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী চিসু নিৎসে * শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
।। নিলুফা ইয়াসমীন হাসান।।
লন্ডন: সার্বিকভাবে সফল ও সুন্দর একটি চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হলো। পহেলা জুন রবিবার পূর্ব লন্ডনের জেনেসিস সিনেমা হলে বিপুল সংখ্যক দর্শকের সমাগমে পর্দা নামলো ২৬ তম রেইনবো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। বিভিন্ন দেশের নান্দনিক ও জনপ্রিয় সিনেমা লন্ডনের দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল রেইনবো সোসাইটি। দেশীয় সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি অন্যান্য সংস্কৃতির সুউপাদানসমূহ গ্রহণের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ছিল এই আয়োজন।

গত ২৫শে মে দুপুর বারটায় পূর্ব লন্ডনের মাইল এন্ড রোডস্থ জেনেসিস সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এক নাগাড়ে ২৫শে মে থেকে পহেলা জুন পর্যন্ত আটদিনব্যাপী চলেছে এই উৎসব।
পহেলা জুন উৎসবের সমাপনী দিনে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আগে অনুষ্ঠিত হয় এওয়ার্ড অনুষ্ঠান। জুরি বোর্ড এর মতামতের ভিত্তিতে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার নির্ধারণ করা হয়েছে ।

শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছে ইরানের ছায়াছবি ‘সামার টাইম’, শ্রেষ্ঠ পরিচালক সৃজিত মুখার্জি (ছায়াছবি ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নাই’), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী চিসে নিৎসু (‘পারফরমিং কারুস ফিউনারেল‘), শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার জিতেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় (ছায়াছবি ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নাই’), শ্রেষ্ঠ গল্প মেক্সিকোর ‘দ্য রিকারেন্ট প্যাশেন্ট‘, জাপান, স্পেইন এবং সিঙ্গাপুরের যৈাথ প্রযোজনার ছবি ‘পারফরমিং কারুস ফিউনারেল‘। মানবতার কেটাগরিতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছে ইরানের ‘গার্লস অফ দ্যা সী’, স্পেশাল জুরি এওয়ার্ড পেয়েছে ইটালিয়ান ছায়াছবি ‘মাইছেলিয়া‘। স্বল্প দৈর্ঘ চলচ্চিত্র কেটাগরিতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ইরানের ‘আয়ার‘, শ্রেষ্ঠ পরিচালক অসওয়াল্ডো মার্টিনেজ (মেক্সিকোর ‘থ্রী এটেম্পটস অফ হোপ‘), শ্রেষ্ঠ গল্প রাশিয়ার ‘ফেন্ছ‘, বিশেষ জুরি পুরুষ্কার পেয়েছে মেক্সিকোর ‘দ্য নোট‘ ছায়াছবি।
রেডব্রিজ বারার কাউন্সিলর সায়মা আহমেদ এবং মুন্তাকিম খানের যৌথ প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় ২৫শে মে রোববার জেনেসিস সিনেমা হলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ভারত থেকে আগত চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবানিক কুণ্ড, রেইনবো সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামাল এবং সাংবাদিক মাসুদ হাসান খান। উদ্বোধনী দিনে প্রদর্শিত হয়েছে ভারতীয় বাংলা ছায়াছবি সৃজিত মুখার্জী পরিচালিত কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় অভিনিত বহুল আলোচিত ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই‘।

পহেলা জুন সমাপনী এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান চমৎকারভাবে যৌথ পরিচালনা করেন চলচ্চিত্র উৎসবের সহকারী পরিচালক বুলবুল হাসান এবং সামির কামাল। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন শামীমা ফেরদৌস, দেবানিক কুণ্ড, নাদিয়া লোদী ও সাদেক আহমেদ চৌধুরী । রেইনবো সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামাল প্রতিবারের মত এবারও দর্শকদের বিপুল সাড়া পেয়েছেন উল্লেখ করে দর্শক এবং যারা ফেস্টিভালের সাথে জড়িত ছিলেন, সহযোগিতা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানান।
পুরস্কার বিতরণী শেষে প্রদর্শিত হয় দর্শক নন্দিত ছায়াছবি ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘এই রাত তোমার আমার’। কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন চিরঞ্জীব বরদোলই এবং পরিচালনা করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। প্রযোজনা করেছেন বিষ্ণু মেহতা। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঞ্জন দত্ত ও অপর্ণা সেন। এতে সম্পর্কের জটিলতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও জীবনসংগ্রামের বাস্তব প্রতিফলন রয়েছে। অপর্ণা সেন এবং অঞ্জন দত্তের অভিনীত ছবির নামটি একটি কালজয়ী গানের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের সুরে এবং ১৯৫৯ সালের “দীপ জ্বেলে যাই” চলচ্চিত্রের জন্য কিংবদন্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গানটি হইচই স্টুডিওজ প্রযোজিত এই নতুন ছবির গল্পকে অনুপ্রাণিত করেছে। চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত এবং চিত্রগ্রাহক করেছেন প্রসেনজিৎ চৌধুরী।
২৫শে মে উদ্বোধনী এবং পহেলা জুন সমাপনী দিন ছাড়াও ২৬শে মে থেকে এক নাগাড়ে ৩১শে মে পুরো ফ্যাস্টিভাল জুড়ে যে সকল চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে তা হলো: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘এখানে নোঙ্গর‘। ভারতের ‘বাডগুমান’ ‘আদিম‘, ‘আলাপ‘, ‘অথৈ‘, ‘চাত্তার‘ , ‘চালচিত্র‘, ‘ডানা মেলার গল্প‘, ‘ঢোলি‘, ‘হেমামালিনি‘, ‘মনপতঙ্গ‘, ‘অমলো‘, ‘পদাতিক‘ ও ‘ভাকাট্টা‘। ফিলিপাইনের “এ ল্যাব স্টোরি‘। ইরানের ‘ক্যাপ্টেন‘, ‘গার্ল ইন দ্য সি‘, ‘সামার টাইম‘, ‘আয়আর‘, ‘ফ্লাইং সসার‘, ‘গিলার‘ ও ‘টেইসেহ‘। মেক্সিকোর ‘ফিউরিয়াস টাইম‘, ‘দ্য রিকারেন্ট প্যাশেন্ট‘, ‘বালাম‘, ‘দ্য নোট‘, ‘থ্রী এটেম্পটস অফ হোপ‘ ও ‘আস‘। জাপান, স্পেইন এবং সিঙ্গাপুরের যৈাথ প্রযোজনায় ‘পারফরমিং কারুস ফিউনারেল‘। ইটালিয়ান ‘মাইছেলিয়া‘। রাশিয়ার ‘আলিসা‘, ‘ফেন্ছ‘, ‘তাইজি‘ ও ‘জাস্ট সে হাই‘। ইউ এস এর ‘আই হিয়ার ইয়োর সাইলেন্স‘।
আটদিনব্যাপী চলা এই চলচ্চিত্র উৎসবে ১১টি দেশের ১১টি ভাষায় সর্বমোট ৩৭টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এরমধ্যে ২৩টি পূর্ণ্যদৈর্ঘ্য এবং ১৪টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র স্থান পেয়েছে। যে সমস্ত ভাষায় চলচ্চিত্রসমূহ প্রদর্শীত হয়েছে তা হলো: বাংলা, ঘারওয়ালি, গুজরাটি, হিন্দি, ইটালিয়ান, জাপানিজ, মায়ান, ফার্সি, স্পেনিশ, টাগলগ এবং রুশ। প্রতিটি সিনেমায় ইংরেজী সাব-টাইটেল ছিল। সব সংস্কৃতির সকল কমিউনিটির চলচ্চিত্রপ্রেমীরা উপভোগ করেছেন প্রতিটি সিনেমা। প্রতিদিনই প্রচুর দর্শকের সমাগম ঘটেছিল। দর্শকরা উপভোগ করেছেন এবং অনেক দর্শক মন্তব্য করেছেন, প্রতি বছর উন্মুখ হয়ে থাকি কখন রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসব হবে, বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সংস্কৃতির ছবি দেখতে পাবো। ‘সুন্দর সমাজ গড়তে চলচ্চিত্র অনন্য ভূমিকা রাখে’ বলেও উল্লেখ করেন দর্শকরা।
চলচ্চিত্র উৎসবকে সাফল্য মন্ডিত করতে ফেস্টিভ্যাল কমিটিতে যারা কাজ করছেন তাঁরা হলেন: মোস্তফা কামাল, বুলবুল হাসান, সামির কামাল, মুন্তাকিম খান, আবু মুসা হাসান, শামিমা ফেরদৌস, দেবানিক কুণ্ড, নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, সৈয়দা সায়েমা আহমেদ, সাদেক আহমেদ চৌধুরী ও কৃষ্ণ সাহা।
জুরি বোর্ডে ছিলেন : ড: ক্লেলিয়া ক্লিনি, লন্ডন মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির লেকচারার। ড: অমিত এস রায়, কুইন মেরী ইউনিভার্সিটি লন্ডন। পুলক গুপ্ত, বিশিষ্ঠ সাংবাদিক। কাজী রুকসানা বেগম, আর্টস ডেভেলপমেন্ট অফিসার, বরো অফ টাওয়ার হ্যামলেটস। সাদেক আহেমেদ চৌধুরী, ফিল্ম ক্রিটিক। আলেকসান্ডার জ্যাকসন, রিচ মিক্স সেন্টার।
উল্লেখ্য, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামালের উদ্যোগে দু‘হাজার সালে লন্ডনে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র উৎসব। এরপর থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই চলচ্চিত্র উৎসব।
রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি যুক্তরাজ্যের একটি অলাভজনক চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যে সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।