“জনতার নয়, ক্ষমতার বাজেট”
অবৈধ দখলদার সরকারের প্রস্তাবিত ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটের কোন রাজনৈতিক বৈধতা নেই। অনির্বাচিত কোন সরকার জনগণের ওপর করারোপের কোন আইনি ক্ষমতা রাখে না। সরকার অন্তবর্তী হলে দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখাই কেবল তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক দর্শন সম্বলিত বাৎসরিক আর্থিক বিবরণী বা বাজেট প্রদান করা তাদের কাজ না। কিন্তু ড. ইউনূসের দখলদার সরকার অন্য সব এখতিয়ারবহির্ভূত কাজের মতো বাজেট প্রণয়নের কাজও করেছে। বাজেট কেবল সংখ্যার সমষ্টি নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়বদ্ধতা, ইউনূস সরকারের প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সেই দায়বদ্ধতা থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত। এটি যেমন জনগণের চাহিদাকে উপেক্ষা করে তৈরি হয়েছে, তেমনি সংবিধান আদিষ্ট রাজনৈতিক নৈতিকতাও এতে অনুপস্থিত।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাজেট হলো জন-প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অনুমোদিত একটি রাজনৈতিক চুক্তি। কিন্তু বর্তমান সরকার একটি প্রশাসনিক কাঠামো—যেখানে সংসদীয় বিরোধী দল, সংসদীয় বিতর্ক কিংবা জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ অনুপস্থিত।
অংশগ্রহণহীনতা ও গণতান্ত্রিক ঘাটতি
এই বাজেট তৈরি হয়েছে নাগরিক সমাজ, অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী সংগঠন, বিরোধী দল, কিংবা শ্রমজীবী মানুষের মতামত ছাড়াই। জনমত যাচাই বা জনসাধারণের প্রস্তাব গ্রহণের কোনো প্ল্যাটফর্মই চালু করা হয়নি। এটি একটি ক্লোজড-ডোর টেকনোক্রেটিক প্রক্রিয়া—যা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারণার পরিপন্থী।
দায় এড়ানোর কথামালা
প্রস্তাবিত বাজেটে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সাফল্যকে কালিমালিপ্ত করতে অসত্য বক্তব্যের ফুলঝুরি ছোটানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, জীবনমানের উন্নতি, অবকাঠামো উন্নয়নের অভাবিত অগ্রগতির সাক্ষী দেশের মানুষ। বিশ্ববাসী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে ‘গ্রোথ মিরাকল’ হিসেবে অভিহিত করতেন। কিন্তু ড. ইউনূসের মাত্র দশ মাসের শাসনে তার সমর্থক পত্রিকাও লিখতে বাধ্য হচ্ছে দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা, অর্থনীতির গতিহীনতা, অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার কথা। সবমিলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। এই অবৈধ সরকার এহেন প্রেক্ষাপটে বাজেট বক্তৃতায় সমস্ত দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের উপর। একদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের উপর দোষ চাপিয়েছে, অন্যদিকে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের লক্ষ্যে কাজ করার কথাও বলেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যদি অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে থাকে এবং ইউনূস সরকারের দোষ মাসে প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের নিচে নেমে আসে, তাহলে পরের বছর এলডিসি থেকে উত্তরণের বাস্তবতা থাকে কি? যদি থাকে তাহলে তা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেই সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের অবস্থায় দেশ পৌঁছালো কীভাবে? খুব সাধারণ যুক্তিতেই সরকারের এই মিথ্যা প্রচারণা খারিজ হয়ে যায়।
প্রস্তাবিত বাজেটের শুরুতেই বলা হয়েছে, তারা প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক বাজেট দেবে না। এটা একটি প্রতারণামূলক বক্তব্য। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ না করে বাজেট প্রণয়ন করা হলো- লক্ষবিহীন গন্তব্যের উদ্দেশে পথচলার মতো। কমিটমেন্ট বা অঙ্গীকারহীনতাই এই সরকারের বড় একটি বৈশিষ্ট্য। বাজেট বক্তৃতাতেও তা দৃশ্যমান স্বাক্ষর রেখেছে তারা। একথা বলে সরকার ৫ দশমিক ৫ শতাংশের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা আওয়ামী লীগ আমলে অর্জিত গড় প্রবৃদ্ধি থেকে অনেক কম। অথচ এবার প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, অথচ স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি হলে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি হবার কথা। লক্ষ্য কম ধরেও তা অর্জনের অঙ্গীকার না থাকায় প্রবৃদ্ধিকেই আক্রমণ করে বসেছে সরকার। অবশ্য সমালোচকেরা বলছেন যে, বড় বড় লুটপাট ও দুর্নীতিকে আড়াল করতে প্রবৃদ্ধির অংক কমিয়ে দেখাতে চায় তারা। কেননা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শ্রমে-ঘামে গড়া চলমান অর্থনীতিতে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবার কথা।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি
প্রবৃদ্ধির পর বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে। দুই অংকের ওপরে চলে যাওয়া মূল্যস্ফীতি কিভাবে পাঁচে আনবে তা নিয়ে বাস্তবোচিত কোন সমাধান দেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসৃত অনেক নীতি যেমন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীসহ সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচির ওপর ভর করে অর্থনীতির গতি বাড়ানোর কথা বলেছে এই বাজেটে। কিন্তু গতি হারানো অর্থনীতিতে অক্সিজেনের সঞ্চার করতে দরকার বিনিয়োগ। সেই বহু কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের কোন রূপরেখাই দেয়নি সরকার। অথচ এডিপি বাস্তবায়নের অদক্ষতা্ ঢেকেছে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে। এডিপির আকার হ্রাস তথা সরকারি বিনিয়োগ কমানোর মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। একদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ নেই, অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস—এই দুই আঘাত দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে অসংখ্য বেকার তৈরি করবে। বাজেটে এই সংকট থেকে উত্তরণের কোন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.৯%—যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ ৫%। শিক্ষা খাতে প্রকৃত অর্থায়ন কমেছে(মুদ্রাস্ফীতির হিসাবে)। ডিজিটাল নজরদারির প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যালয় ও হাসপাতাল চালু রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯–১০ শতাংশ। এই অবস্থায় যেখানে সাধারণ মানুষের চাল, ডাল, তেল, ওষুধ কেনার ক্ষমতা কমে গেছে, সেখানে বাজেটে পর্যাপ্ত খাদ্য ভর্তুকি বা নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো কৌশল নেই। এই বাজেটে সাধারণ মানুষের—বিশেষত দরিদ্র, প্রান্তিক ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবিকার প্রশ্নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। উপরন্তু, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ্য ভাতা বা বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করা হলেও বেসরকারি বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা থাকছেন সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। এতে করে সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়বে। অথচ কর্পোরেট কর ছাড়, সাশ্রয়ের কথা বলে সরকারের উচ্চবর্গের মানুষের সুযোগ-সুবিধায় উদারতা এই বাজেটের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ঋণনির্ভর বাজেট ও কর কাঠামোর দুর্বলতা
এই বাজেটের একটি বড় অংশ অর্থায়ন করা হবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে। রাজস্ব আয়ের বড় অংশ এখনও আসে শুল্ক (ভ্যাট) ও পরোক্ষ কর (ট্যাক্স) থেকে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর চাপ তৈরি করে। কিন্তু ধনীদের ওপর প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো, কর ফাঁকি রোধ বা সম্পদের উপরে কর আরোপের মতো সাহসী সিদ্ধান্ত এই বাজেটে অনুপস্থিত।
উন্নয়নের নামে শহরকেন্দ্রিক পক্ষপাত
অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে এখনো মেগা প্রকল্প আর শহরভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নকে বোঝানো হচ্ছে। গ্রামের কৃষক, হাওর এলাকার বাসিন্দা, উপকূলের জলবায়ু বাস্তুচ্যুত জনগণ—তাদের জন্য নেই কোনো আলাদা পরিকল্পনা বা পর্যাপ্ত বাজেট। অথচ, বাংলাদেশের প্রায় ৬৫% মানুষ এখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি ও গ্রামের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের নির্দেশনা নেই।
সংকটের সময়ে সাহসহীন বাজেট
বাংলাদেশে বর্তমানে ডলার সংকট, রেমিট্যান্সের হ্রাস, বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি, বেকারত্ব এবং জলবায়ু ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছিল একটি সাহসী, পুনর্বিন্যাসকৃত এবং বৈষম্যহ্রাসক বাজেট। কিন্তু এই বাজেট নতুন কোনো দিগন্ত উন্মোচন করেনি। এটি গতানুগতিক, শহরমুখী, আমলাতান্ত্রিক এবং জনবিচ্ছিন্ন বাজেট হিসেবেই উপস্থাপিত হয়েছে।
• ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৯% হ্রাস পেয়েছে, এবং পূর্ববর্তী কয়েক বছরের গড় বাজেটের তুলনায় এটি প্রায় ১০% কম। অন্যদিকে, আগের বছরগুলোতে বাজেট গড় হিসাবে প্রতি বছর ১০% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুই দিক বিবেচনায়, নতুন বাজেটটি পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ২০% কম।
• উন্নয়ন খাতে গুরুত্ব কমেছে, কারণ উন্নয়ন ব্যয়ের বরাদ্দ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় গড়ে ১০% হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বিনিয়োগ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
• ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের মোট দায় ২০২৪-২৫ সালের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫% বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। এর মানে, সরকার আগামী বছর বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, যার ফলে প্রতি নাগরিকের ওপর দায়ভার আরও বাড়বে।
• বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ৩৫% হারে হ্রাস করা হয়েছে, যা দেশের বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে হুমকির মুখে ফেলবে, এবং অর্থনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। একই অবস্থা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতেও, যেখানে ৯% বাজেট কাটছাঁট হতে পারে। এতে দেশের সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)-এর সাথেও সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি তার মানুষ। তাদের কণ্ঠস্বর, প্রয়োজন ও মর্যাদা প্রতিফলিত না হলে কোনো বাজেটই জনকল্যাণমুখী হতে পারে না। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একতরফা নীতির বহিঃপ্রকাশ, যা দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই বাজেট গণতান্ত্রিকতার ঘাটতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক বিচ্যুতির একটি রূপরেখা মাত্র। বাংলাদেশকে প্রয়োজন একটি মানবিক, অংশগ্রহণমূলক এবং বৈষম্যহ্রাসক বাজেট, যা গণতন্ত্রের ন্যায্য ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনে করে, এই বাজেট দেশের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না, বরং দেশের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল ও পঙ্গু করবে। দেশকে আরও সংকটে পতিত করবে। ফলে এই বাজেট ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।আঁধার কেটে ভোর হোক বাংলাদেশ মুক্তি পাক।