ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যরাত ছুঁয়েছে, তখন সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে চলছে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ। কালী মন্দির—একটি সার্বজনীন, বহু বছরের পুরোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে শতাধিক দুর্বৃত্ত। প্রতিমা, ছবি, সীমানা দেয়াল—সব কিছু ধূলিসাৎ করে, ওই জমিতে রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে নতুন এক প্রাচীর। যে জায়গাটি ছিল পূজার থানে, তা এখন শক্তি ও দখলের বেদীমূর্তি।
এটা নিছক ভূমিদস্যুতা নয়। এটা নিছক ধর্মীয় সহনশীলতার অভাবও নয়। এটা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ছত্রচ্ছায়ায় চলমান একপ্রকার ইসলামি মৌলবাদী শাসনের নগ্ন প্রকাশ, যেখানে সংখ্যালঘু হওয়াটাই অপরাধ। যেখানে হিন্দু মন্দির মানেই ফাঁকা জায়গা—যা যেকোনো সময় দখল করা যায়, ভাঙা যায়, মুছে ফেলা যায়।
এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। এটা ধারাবাহিকতার অংশ। দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের মন্দির, ঘর, জমি, অস্তিত্ব—সবকিছুর ওপরে চলমান এক নিঃশব্দ যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের নেতৃত্বে রয়েছে মোহাম্মদ ইউনুস নামক এক ব্যক্তি, যিনি কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, প্রশাসনের গলা চেপে ক্ষমতা দখল করে এখন এক অদৃশ্য অথচ ভয়ংকর ছায়া সরকার চালাচ্ছেন। তিনি নিজে নেই কোথাও, অথচ তার লোকজন আছে সর্বত্র—থানায়, প্রশাসনে, মিডিয়ায়, ভূমি অফিসে, স্থানীয় ‘গণ্যমান্য’দের ঘরে।
জঙ্গল সলিমপুরের কালী মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় পুলিশ কোথায় ছিল? একটা রাত, একটা মন্দির, শতাধিক মানুষ—এমন আক্রমণ কি কেউ স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করে পারবে যে, নিরাপত্তা বাহিনীর ঘুম ভাঙেনি? তা-ও আবার এমন এক সময়, যখন দেশের প্রতিটি মোড়েই সিসিটিভি, ড্রোন, গোয়েন্দা তৎপরতা। আসল সত্য হচ্ছে—এটি ‘অ্যাপ্রুভড’ আক্রমণ ছিল। অনুমোদিত দখল। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পরিচালিত এক ধরণের ‘সায়েন্টিফিক নিপীড়ন’, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেবল দর্শক নয়, অনেক সময় সরাসরি সুবিধাভোগী।
মন্দির ভাঙা মানে শুধু ইট-কাঠ নয়, ভেঙে দেওয়া হয় বিশ্বাস, ইতিহাস, উপস্থিতি। এই মাটি তো কারও বাপের না, বলা হয় সবসময়। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেটাই ভুল প্রমাণ হচ্ছে—এই মাটি এখন ইউনুসদের, সেই সব ইসলামি জঙ্গিদের, যারা গণতন্ত্রের নামে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে ব্যস্ত। অথচ তারা পশ্চিমে চোখ তুলে বলে—‘আমরা ধর্মনিরপেক্ষ’। ভণ্ডামির এমন স্পষ্ট চেহারা আর ক’টা দেশে আছে?
তাদের ক্ষমতা এতটাই নিশ্চিত যে, একটি মন্দির গুঁড়িয়ে তারা রাতারাতি দেয়াল তোলে। কোনো লুকোচুরি নেই। দিনের আলোয় পুলিশ এসে ‘পরিদর্শন’ করে, রিপোর্ট নেয়, এবং ব্যাস। এরপর যা হয়, তা হচ্ছে না হওয়া—ফাইল চাপা পড়ে, জমি চলে যায়, ইতিহাস বদলে যায়।
অথচ যারা এই দেশে জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে, স্কুলে গল মিলিয়ে পড়েছে—‘সকল ধর্মের মানুষের জন্য বাংলাদেশ’—তারা আজকে চোখের সামনে দেখে, ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কারা চালায়। তারা বুঝে গেছে, ভোটের ফল নয়, অস্ত্রধারীদের সাথে সম্পর্কই এখানে ক্ষমতার উৎস। আর সেই ক্ষমতা এখন পূর্ণমাত্রায় ইসলামি মৌলবাদীদের হাতে। এমনকি ‘নিরপেক্ষ’ বা ‘অরাজনৈতিক’ মুখোশ পরে যারা আছে, তারাও মূলত সেই একই মঞ্চের অভিনেতা।
এই যে হামলা, এটা পরিকল্পিত। রাষ্ট্রীয় ছত্রচ্ছায়ায় সংগঠিত একধরনের নির্মূল অভিযান। সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার জন্য, ইতিহাস থেকে তাদের নাম মুছে ফেলার জন্য।
এই লেখার শেষে কোনো আশার কথা নেই। কোনো ‘মানবাধিকার সংস্থা তদন্ত করবে’ টাইপ ভদ্রতা নেই। কারণ আজকের বাংলাদেশে মানবতা বলতে কিছু নেই, সংখ্যালঘু বলতে শুধু দুর্ভাগা লোকদের একটা তালিকা, আর আইনশৃঙ্খলা মানে হচ্ছে—ক্ষমতার লেজ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সশস্ত্র দালালদের একটা বাহিনী।
এখানে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। শুধু প্রশ্ন—এরপর কোন মন্দির? কার ঘর? কোন ধর্ম?
আমরা জানি না। কিন্তু যারা জানে, তারা নিশ্চুপ নয়—তারা ব্যস্ত দখলে, ভাঙনে, নির্মূলে।