মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এই নিয়ে নানা বিতর্কসহ চলছে নানা আলোচনা। প্রজ্ঞাপন নিয়ে ভুল খবরের জেরেই এই বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলে মনে করে সরকার। অনেকে বলছেন, নানা ইস্যুতে জেরবার সময়ে স্পর্শকাতর বিষয়ে এই উদ্যোগের কী প্রয়োজন ছিল? এটি অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেছে। প্রজ্ঞাপন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় গতকাল সংবাদ সম্মেলনে পুরো বিষয় পরিষ্কার করেন মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম। তিনি জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে মঙ্গলবার রাতে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করে সরকার।
অধ্যাদেশে নতুন সংজ্ঞায় বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন-
“যাহারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং
“বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন্ন বয়সের মধ্যে); এবং
“সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্যরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।”
একই সঙ্গে অধ্যাদেশের নতুন সংজ্ঞায় “হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা)” বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
পাশাপাশি “মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারীরাও” হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায় যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, তাদের পাঁচ ক্যাটাগরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন;
যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন;
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ; যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন;
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর কিছু গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে উল্লেখ করে খবর প্রকাশ করে। এতে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক তৈরি হয়।
বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল, এসব নেতার পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে নির্ধারণ করার বিষয়টি সঠিক নয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম। উপদেষ্টা জানান, অধ্যাদেশে মুজিবনগর সরকারকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুসহ মুজিবনগর সরকারের অন্যদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা বাতিলের বিষয়ে যা বলা হচ্ছে- সেটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে। এটাকে ইতিহাসভিত্তিক করা হয়েছে। যারা সশস্ত্রভাবে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন এবং এই যুদ্ধ যারা পরিচালনা করেছেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা হবেন। মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য যারা দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সহযোগিতা করেছেন, কাজ করেছেন, যারা সশস্ত্র ছিলেন না, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হবেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের যে কথাটি বলা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়। সঠিক নয় এই অর্থে যে, এখানে (অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়) সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যেটা মুজিবনগর সরকার এবং এ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা হবেন। তার মানে মুজিবনগর সরকার নিজে এবং তার দ্বারা স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনীর যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা হবেন।
মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, তাহলে মুজিবনগর সরকারের মধ্যে কে ছিলেন? শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও খন্দকার মুশ্তাক সাহেব ছিলেন। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ফারুক-ই আজম বলেন, এই যুদ্ধটা এ সরকার (মুজিবনগর সরকার) পরিচালনা করেছে, এই সরকারের লেজিটিম্যাসির (বৈধতা) বাইরে কাউকে স্বীকৃতিই দেয়া হয়নি। এই সরকারটাই ছিল তখন স্বীকৃত সরকার। আবার অর্থটা এমন দাঁড়ায় কি না, এই সরকার হয়তো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করলো, কিন্তু তারা তো সরাসরি রণাঙ্গনে অংশ নেয়নি- এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, এটা হয়নি। কারণ রণাঙ্গন উনারা পরিচালনা করেছেন। তাহলে তো একই কথা আপনি সেক্টর কমান্ডারদের ক্ষেত্রেও বলতে পারেন। তাহলে তারা কি যুদ্ধ করেননি? যুদ্ধ ডিজাইন করেছেন, যুদ্ধে কারা যাবে, না যাবে- পরিচালনা করেছেন। ঠিক একইভাবে তো মুজিবনগর সরকার তো পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেশন কোথা থেকে আসবে, অস্ত্র কোথা থেকে আসবে- এগুলো ওই সরকার (মুজিবনগর সরকার) করেছে না? এটাতো ঐতিহাসিক সত্য যে, এ সরকার পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে। কেমন করে এই ইতিহাস পরিবর্তন করা যায়। তিনি আরও জানান, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের সংবাদটি মিসলিডিং হয়েছে, এটি সত্য হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায়ও মুজিবনগর সরকারের বিষয়টি এসেছে, এ বিষয়ে ফারুক-ই আজম বলেন, ওটা মুজিবনগরের কর্মচারীরা। মুজিবনগর সরকারের অধীনে যে সকল বেতনধারী কর্মচারী ছিলেন, তাদেরকে বলা হয়েছে সহযোগী, সরকারকে বলা হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলোর সঙ্গে সিরিজ মিটিং করেছি। এটা তাদের সবারই দাবি এটা আমরা নতুন করে প্রবর্তন করিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সংজ্ঞা ১৯৭২ সালে ছিল, ২০১৮তে এসে এই সংজ্ঞাটা পরিবর্তন করা হয়। ২০২২-এ এসেও পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২ সালে যে সংজ্ঞাটা ছিল আমরা সেটা ফিরিয়ে নিয়েছি। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখা। আমি দাবি করছি- আমি মুক্তিযোদ্ধা, উনি দাবি করছেন উনি মুক্তিযোদ্ধা। শাশ্বতভাবে সারা দেশের মানুষ জানে কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সুস্পষ্ট জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, অধ্যাদেশ করার আগে যাচাই হয়েছে, ভেটিং হয়েছে অনেক কিছু হয়েছে। আপনি যদি টুইস্ট করতে চান করতে পারেন। এটা তো অল টুগেদার ডিফারেন্ট জিনিস। আমরা ইতিহাস চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধটা যাতে কেউ বিতর্কিত না করতে পারে।