স্বীকার করি—লিচু আমার সবচেয়ে প্রিয় ফল নয়। হ্যাঁ, এটা শুনে অনেকে চমকে উঠতে পারেন। কারণ, আমরা সবাই জানি, গ্রীষ্মের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলগুলোর একটি লিচু। ছোট্ট লাল রঙের খোসার নিচে লুকানো থাকে মিষ্টি স্বাদ। কিন্তু তবু জানি না, কেন আমি কখনো লিচুতে তেমন একটা মুগ্ধ হইনি। তবে এই লিচুই আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ফল হয়ে থাকবে।
কেন? কেন তা তো নিশ্চয়ই আপনারা এতক্ষণে বুঝে গেছেন। আমার জীবনের প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমার প্রথম পারফর্ম করা গানের নামই ‘লিচুর বাগানে’। মঙ্গল মিয়া, আলেয়া বেগম, প্রীতম হাসান, জেফার রহমান—কী দুর্দান্ত গেয়েছেন সবাই! সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো দর্শক পর্দায় মেগাস্টার শাকিব খান ও আমার রসায়ন দেখেছেন। শাকিব খান—মেগাস্টার, আইকন, সিম্পলি দ্য বেস্ট ইন দ্য ইন্ডাস্ট্রি ফর টোয়েন্টি সিক্স ইয়ারস। তাঁর সঙ্গে কাজ করা একদিকে যেমন ছিল রোমাঞ্চকর, একই সঙ্গে ছিল ভয়ের ব্যাপারও। কিন্তু যখন আসলেই কাজ শুরু করলাম, সবকিছু কেমন অদ্ভুতভাবে সহজ হয়ে গেল। বুঝতেই পারিনি, এটা ছিল আমাদের প্রথম একসঙ্গে পর্দা ভাগাভাগি করার অভিজ্ঞতা। আর ‘লিচুর বাগানে’ গানে একসঙ্গে নাচতে পেরে তো পুরো অভিজ্ঞতা আরও মিষ্টি হয়ে উঠল।
ব্যাপারটা দাঁড়াল দিনাজপুরের সবচেয়ে সুখ্যাত বাগানের দামি লিচুর মতো, বাইরে লাল রঙের ফিফটি শেডসের আবরণ, সেটা খুললেই মেঘলা আকাশের মতো শাঁস, রসে টইটম্বুর, আর মুখে পোরা মাত্রই অমৃত। এর জন্য পরিচালক রায়হান রাফী এবং পুরো টিমকে অনেক ধন্যবাদ।
দর্শক আমাদের গানটি পছন্দ করেছেন। গানটি ইউটিউবে দেখছেন, টিকটকে ডান্স কাভার করছেন, গুনগুন করে গাইছেন। আমি কৃতজ্ঞ যে এই গানের মাধ্যমে আমরা আমাদের দর্শকের সঙ্গে এক টুকরা মিষ্টি অনুভূতি ভাগ করে নিতে পেরেছি। আমি দেখেছি, মানুষ কীভাবে লিচুর মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করে, কীভাবে একসঙ্গে বসে লিচু খায়, গল্প করে। এখন কিন্তু লিচু খেতে খেতে ‘লিচুর বাগানে’ গানটি উপভোগ করে, সুরের ঢেউয়ে পা ছন্দে ছন্দে মেলালে মন্দ হবে না।
এর আগে তুফান–এর গান ইউটিউবে ওয়ার্ল্ড ট্রেন্ডিংয়ে টপ চার্টে এসেছিল। আমাদের জন্য সুসংবাদ, প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ‘লিচুর বাগান’–এর ভিউ আমাদের আরও বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
এই নতুন রূপে দর্শকেরা আমাকে নেবেন কি না, ভীষণ একটা চিন্তায় ছিলাম, দর্শক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের তারকারা আমার এই নতুন ধরনের পারফরম্যান্সকে স্বাগত জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন। এখন আমি অনেকটাই নির্ভার।
প্রশ্ন করতে পারেন, আমি কোনো দিন লিচুর বাগানে গিয়েছি কি না। হ্যাঁ। আব্বুর ছিল বদলির চাকরি। ক্লাস টু–থ্রিতে পড়ি তখন। ঢাকার স্কলাস্টিকায়। আব্বু তখন খুলনায়। বেড়াতে গেলাম খুলনায়। বাসার চারদিকে কত গাছ। আর একটা লিচুবাগান।
ছোট্ট আমি চলে গেলাম সেই লিচুবাগানে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’–এর কথা মনে পড়ল। আর এখন, এত দিন পর মনে পড়ছে সেই লিচুগাছের আশ্চর্য সবুজ পাতা, আর কী একটা মন উদাস করা ঘ্রাণ! সেই ঘ্রাণ প্রকৃতির, তরুলতার, মাটির আর লিচুর ফুলের।
এখন আমি ‘লিচুর বাগানে’ নামে তাণ্ডব সিনেমার একটা নৃত্যগীতের এক প্রধান কুশীলব। জীবন আপনাকে কোথা থেকে কোথায় যে নিয়ে যায়! এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি দর্শকের ভালোবাসা।
আমার লেখা শেষ। শুধু দুটো তথ্য পরিবেশনের লোভ সামলাতে পারছি না।
১. লিচু চীন থেকে আসা ফল। ইংরেজ লেখক টমাস মেকলে বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তা থেকে জানা যায়, ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলা থেকে লিচুর চারা নিয়ে গিয়েছিলেন বিলেতে, সেখানে লিচু ফলানোর চেষ্টা করেছিলেন। ইংরেজ সাহেবরা সব ছাড়তে পেরেছিলেন, শুধু বাংলার লিচুর মায়া ছাড়তে পারেননি।
২. লিচুর বাগানের নাচের জন্য তিন দিন অনুশীলন করেছি। প্রথম দিনেই তুলে ফেলতে পেরেছিলাম, তার পরের দুদিন পারফেকশন আনার চেষ্টা। আর শুটিংয়ের জন্য সময় দিতে হয়েছে তিন দিন। এর মধ্যে এক দিন পুরো ২৪ ঘণ্টা কেটেছে স্টুডিওতে, সারা রাত শুটিং হয়েছে। পরিশ্রম করেছি, সবুর করেছি, দেখা যাক, ফলটা কী দাঁড়ায়। সবুরে লিচু ফলে কি না! আপনাদের সবার ঈদ শুভ হোক।