।। নাবিলা খান।।
আজ ৭ জুন, ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস। ভোরের স্ফটিক রৌদ্রের মত বীর বাঙালি জাতির দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য আত্মত্যাগের গৌরবজ্জ্বল দিন আজ। ছয় দফা দাবি মূলত ছিল বাঙালির প্রথম মুক্তির সনদ। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সম-অধিকার চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ছয়টি দাবিতে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তার মূলে ছিল বাংলার স্বায়ত্তশাসন। এই ছয় দফা দাবির মধ্য দিয়েই বাঙালি স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।
বাঙালি জাতির ‘ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি’। অথচ সেই খনি ভেদ করে শোনা গিয়েছিল শুশ্রুষার মত এক বজ্রকণ্ঠ ধ্বনি– যে ধ্বনি ছিল বঙ্গবন্ধুর, যে ধ্বনি ছিল আমাদের মুক্তির মণি। অথচ আজ এমন এক সময়ে ছয় দফা দিবস নিয়ে লিখতে হচ্ছে– যখন আমাদের গৌরবময় অর্জনকে মুছে ফেলার সমস্ত আয়োজন চলছে। এক অন্তহীন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমস্ত অতীত, বর্তমান, সেই সঙ্গে ভবিষ্যতও। সম্প্রতি বাংলাদেশের সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাসে পরিবর্তন এনেছে, যাতে বাদ দেয়া হয়েছে – ছয় দফা আন্দোলন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের গঠন ও কার্যাবলি।
আগের সিলেবাসে বাংলাদেশ বিষয়াবলির ১ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘বাংলাদেশের জাতীয় বিষয়াবলি’ অংশে ছিল ‘প্রাচীনকাল হতে সমসাময়িক কালের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস; ভাষা আন্দোলন; ১৯৫৪ সালের নির্বাচন; ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৬; গণঅভ্যুত্থান ১৯৬৮-৬৯; ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন; অসহযোগ আন্দোলন ১৯৭১; ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ; স্বাধীনতা ঘোষণা; মুজিবনগর সরকারের গঠন ও কার্যাবলি; মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল; মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা; পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়।’ ২১ মে, ২০২৫ তারিখে প্রণীত নতুন সিলেবাসে এই বিষয়গুলো বাদ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সিলেবাসটি ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের জন্য হলেও এর অনেক কিছু আগামীতে রাখা হবে। এই অধ্যায়গুলো শুধু পাঠ্য বিষয় নয়—এগুলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জন্মসনদ, জাতির আত্মপরিচয়ের মৌলিক উপাদান। এগুলো বাদ দেওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করা, ইতিহাসকে বিকৃত করা, আর রাজাকারমনস্ক এক নতুন প্রজন্ম তৈরি করার চক্রান্ত।
১৯৬৫ সালের ১ আগস্ট ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রণয়নের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করার জন্য দলকে নির্দেশনা দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এবার তাঁর বক্তৃতায় ‘ছয় দফা’ শব্দটি উচ্চারিত হয় বারবার। এরপর ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয়দফা উত্থাপন করেন তিনি।
১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরের সেই বিরোধী দলীয় সম্মেলনে ৭৪০ জন প্রতিনিধি ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে গিয়েছিলেন মাত্র ২১জন। মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ এবং এনডিএফ এই সম্মেলন বর্জন করে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ থেকে গিয়েছিলেন ৫ জন প্রতিনিধি। ছয় দফা উত্থাপনের পর বাকি ৭৩৫ জন প্রতিনিধি তাৎক্ষণিক বিরোধিতা করে প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। বঙ্গবন্ধু সম্মেলন বয়কট করে তাঁর দলের বাকি চারজনকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর ২৩ মার্চ ১৯৬৬, ঢাকার হোটেল পূর্বাণী-তে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা দাবিগুলো জাতির সামনে উপস্থাপন করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফাকে শুধু শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ছুটে যান গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, মাঠে-ঘাটে, সাধারণ মানুষের কাছে ছয় দফার অর্থ তুলে ধরতে। তিনি ছোট ছোট জনসভায় ছয় দফার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতেন সহজ-সরল ভাষায়, যেন মৃত্তিকালালিত গ্রামের সাধারণ কৃষকও তা বুঝতে পারে। এ সময় তিনি বলতেন, “এই ছয় দফা তোমার আমার মুক্তির সনদ।” আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন ছয় দফার প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়তে। “এক দফা – ছয় দফা” স্লোগান সেসময় সারাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তরঙ্গবেগে।
সারাবেশের তৃণমূলের মাঝে ছয় দফা দাবির যৌক্তিকতা ছড়িয়ে দিয়ে ও গণমানুষের সমর্থন আদায় করে ৭ জুন আওয়ামী লীগ আহ্বান করে হরতালের। এদিন ঢাকায় পুলিশের গুলিতে মনু মিয়া ও শফিউল বারী শহীদ হন। নারায়ণগঞ্জে শহীদ হন নাজিমউদ্দিন ও শামসুল হক। এই ঐতিহাসিক দিনের স্মরণেই পালিত হয় ছয় দফা দিবস।
সেই দিন থেকেই ছয় দফা হয়ে ওঠে জনগণের আত্মার দাবি, আর শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন “বঙ্গবন্ধু”।
এই ছয় দফা হলো:
১. পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠান।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুটি বিষয় থাকবে—প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্য সব বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
৩. সারা দেশে হয় অবাধে বিনিয়োগযোগ্য দুই ধরনের মুদ্রা, না হয় বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একই ধরনের মুদ্রা প্রচলন করা।
৪. সব ধরনের কর ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায় করা রাজস্বের একটা নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
৫. অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে। এর নির্ধারিত অংশ তারা কেন্দ্রকে দেবে।
৬. অঙ্গরাজ্যগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া।
৬ দফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিকসহ সব অধিকারের কথা তুলে ধরে।
আইয়ুব খান সরকার ৬ দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই ছয় দফার দাবি ছিলো গণজাগরণের কেন্দ্রবিন্দু। আইয়ুব খানের শাসন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ, ও রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে এই ছয় দফাই ছিল সবচেয়ে দৃঢ় জবাব। একে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক বিক্ষোভ, হরতাল। এর পথ ধরেই আসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, শুরু হয় গণ অভ্যুত্থান, আইয়ুব খানের পতন হয়, মুক্তি পান শেখ মুজিব। এরপর আসে সত্তরের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়, সাত-ই মার্চের ভাষণ, যার পথ ধরে ঘটে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ, অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফা দাবিকে কেবল লাহোর অধিবেশনে কিংবা হোটেল পূর্বাণীতে ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি এই দাবিগুলো নিয়ে গণমানুষের কাছে গিয়েছেন, সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন এর প্রয়োজনীয়তার কথা, তৃণমূলকে করেছেন ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত। আজকের এই ক্রান্তিলগ্নে, রাজাকারদের তোষণকারী অবৈধ ইউনূস সরকার যখন তার ‘রিসেট বাটন’ চেপে মুছে ফেলতে চাইছে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের যাবতীয় অর্জন– তখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে, তাঁরই শেখানো সাহসিকতায়। নগর ছেড়ে আমাদের যেতে হবে মৃত্তিকা-সংলগ্ন সেই মানুষদের কাছে, তৃণমূলের কাছে। সংগঠিত করতে হবে তাদের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শে উজ্জীবিত করতে হবে। যে প্রজন্মের কাছ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে ইতিহাসকে, তাদের কাছেই যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর দর্শন নিয়ে। আমরা জেগে থাকলেই ইতিহাস জেগে থাকে। ইতিহাসের সুন্দরতম গল্পগুলো যে গানে জমাট বাঁধে, তার নাম জাগরণ– মানুষের জাগরণ। এই মানুষের গণজাগরণই ঘটাতে হবে আবার আমাদের – বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর আর একাত্তরের মতো। বাঙালি যখনই বাধা পেয়েছে, তখনই প্রতিরোধে সোচ্চার হয়েছে। আমাদের চেতনার কিরণে নিমেষে বিকীরিত হয়ে উঠুক সংগ্রামের পটভূমি, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে চলুক আমাদের স্মৃতির লড়াই।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক।