।। আল আমিন রহমান।।
বাংলাদেশের বাজারে মোট কী পরিমাণ টাকা আছে, সেটা বলা কঠিন! তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া বিভিন্ন হিসাব বিবেচনায় নিলে বলা যায়, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সরবরাহ করা মোট মুদ্রার বাজার মূল্য ১৭ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ছাপানো নোট আকারে বাজারে আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। কয়েনের পরিমাণ কত সেটা সরকার কখনোই জানায় নি। তবে এর পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার মত বলে ধারণা করা হয়।
ঈদকে সামনে রেখে বাজারে নতুন নোট এসেছে। একে একে সব নোট ছাড়া হচ্ছে বাজারে। বাজারে থাকা সব নোট ধীরে ধীরে তুলে নেয়া হবে। এটা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ! নোটের ডিজাইন কেমন হলো সেসব নিয়ে লোকজন কথা বলছেন। কিন্তু পেছনে পড়ে থাকছে এক অজানা গল্প! এটা নিয়ে বরং কথা বলা যাক!
বাংলাদেশের যেখানে টাকা ছাপা হয় তার নাম টাঁকশাল। সেখানে যে মেশিনে টাকা ছাপা হয়, সেগুলো প্রায় ৪০ বছর পুরোনো। কিন্তু এবার সরকার টাকা ছাপাচ্ছে নতুন মেশিনে। মেশিন কিনতে খরচ হয়েছে আড়াইশ কোটি টাকার বেশি! এ ছাড়া ছাপানোর পেছনে অন্যান্য খরচ হিসেব করলে এ খরচ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যেহেতু প্রতিটি নোটেরই নতুন করে জিজাইন করা হয়েছে, ফলে এর পেছনে বড় একটা খরচ নিশ্চয় হয়েছে।
এর বাইরে প্রতিটা ১০০০ টাকার নোট নতুন করে ছাপাতে ৫ টাকা খরচ হয়। ৫০০ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা। ২০০ টাকার নোটে ৩ টাকা ২০ পয়সা, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা, ১০, ২০, ৫০ টাকার সব নোটেই অন্তত দেড় টাকা করে খরচ হয়। আর ৫ টাকা, ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে গড়ে ১ টাকা ৪০ পয়সা।
তার মানে বাজারে যে, ২ লাখ পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকার নোট আছে, সেগুলো তুলে নিতে সরকারের খরচ কত হবে জানি না, কিন্তু আমি যদি গড়ে প্রতি ১০০ টাকা ছাপাতে ২ টাকা খরচও ধরি (যদিও গড় খরচ আরো বেশি হওয়ার কথা), তাহলে বাংলাদেশের বাজারে থাকা সমপরিমাণ টাকা ছাপাতে সরকারের খরচ হবে—কমপক্ষে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা!
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কয়েন তৈরিতে! প্রতিটি কয়েনে প্রায় সমপরিমাণ টাকা খরচ হয়। মানে, একটা ৫ টাকার কয়েন বানাতে ৫ টাকা লেগে যায়! তার মানে বাজারে থাকা ৪০০০ কোটি টাকার কয়েন তুলে নিয়ে নতুন করে বানাতে সরকারের খরচ পড়বে ওই টাকার সমান, মানে আরো ৪০০০ কোটি টাকা। যদিও সরকার কয়েন তুলে নিয়ে নতুন করে কয়েন বাজারে ছাড়বে কিনা, এই বিষয়ে আমার জানা নাই।
তার মানে এই দাঁড়াল যে, অন্তবর্তীকালীন সরকার বাজারে থাকা নোট তুলে নিয়ে নতুন নোট ছাড়তে ও নতুন নোট ছাপাতে খরচ করছে প্রায় কমবেশি ২০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে কি করা যেতে এবার সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক!
২০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে অল্প কিছু যোগ করে আরেকটা পদ্মা সেতু করা যেত! বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজারের মত। অন্তত ২০ হাজার স্কুলে নতুন ভবন বানিয়ে দেয়া যেত। প্রতিটা ভবনের পেছনে ১ কোটি টাকা বাজেট ধরলাম! প্রায় ১০০টা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হতো। যেখানে গত বছর ঢাবির গবেষণা খাতে বাজেট ছিল ২০ কোটি টাকা। জাহাঙ্গীরনগরে এই বাজেট ছিল অস্বাভাবিক কম, মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরো খারাপ!
শুধু কি তাই? সরকার যে বিভিন্ন খাতের দরিদ্র মানুষদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দেয়, তাদের জন্য মাথাপিছু প্রতি মাসে বরাদ্দ এবার ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে! অথচ ওই টাকাটা এখানে আসলে সেটা ১০০০ টাকায় উন্নীত করা যেত। যদিও এই সরকারের আমলে অনেক মাস ধরেই প্রায় অধিকাংশ সামাজিক ভাতা বন্ধ! ফলে দরিদ্র মানুষ সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছে!
বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, গত ৯ মাসে অন্তত ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র অবস্থায় নেমে গেছে, অতি দরিদ্র মানে—দিনে আয় ২০০ টাকার কম! এই মানুষগুলোকে একটু উপরের দিকে টেনে তোলা যেত ওই টাকাটা দিয়ে।
সরকার এসব না করে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন নোট ছাপাচ্ছে। কেনো ছাপাচ্ছে জানেন? শুধু পুরোনো সব নোটে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আছে বলে! শুধু তাই না, বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে বলে গত ঈদে নতুন কোন নোটই বাজারে ছাড়া হয় নাই! এই হলো সংস্কার!