।। ড. মাহফুজ পারভেজ।।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের নয়াদিল্লিস্থ গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) ৭ জুন তাদের ওয়েবসাইটে ‘The Rise of the NCP and Bangladesh’s Descent into Chaotic Politics’ শিরোনামে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে, যা যৌথভাবে রচনা করেছেন আদিত্য গৌদারা শিবমূর্তি ও মধুরিমা প্রামাণিক। যে বিশ্লেষণে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্র ও বিশৃঙ্খল পতনের মাঝামাঝি এক ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে’।
আদিত্য গৌদারা শিবমূর্তি হলেন অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) কৌশলগত গবেষণা কর্মসূচির প্রতিবেশী অধ্যয়ন উদ্যোগের একজন সহযোগী ফেলো। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত ও নিরাপত্তা-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় এবং বিকাশের ওপর মনোযোগ দেন আর মধুরিমা প্রামাণিক ওআরএফ -এর কৌশলগত গবেষণা কর্মসূচিতে একজন ইন্টার্ন। তার কাজ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, কৌশলগত ও নিরাপত্তা-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় ও বিকাশের ওপর কেন্দ্রীভূত।
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রতি ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের জন্য একটি অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে। এই সংশোধনের আওতায় আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দলটির ও এর নেতাদের বিচার শেষ করে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রভাব ফেলেছে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)‘র—বাংলাদেশের প্রথম ছাত্রনেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের—তিন দিনের বিক্ষোভ, যা আরও কয়েকটি রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজন করা হয়েছিল।
আদিত্য গৌদারা শিবমূর্তি ও মধুরিমা প্রামাণিক তাদের বিশ্লেষণে বলেছেন, এনসিপির আবির্ভাব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে দল ও সংগঠনগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব নির্দেশ করে। তবে ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিভিত্তিক রাজনীতির সংকুচিত পরিসর এই নতুন শক্তিগুলোর জন্য এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।
তারা মনে করেন, নির্বাচনের আহ্বান, আওয়ামী লীগের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং বিএনপির ক্রমবর্ধমান গতি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যেখানে এনসিপির মতো নতুন দল ও সিস্টেমে বিরক্ত তরুণরা অন্যান্য কঠোরপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলাতে প্ররোচিত হতে পারে। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রে একটি প্রজন্মগত পরিবর্তন এবং ক্রমবিকাশমান আদর্শিক সংঘাতকে তুলে ধরে।
বিশ্লেষণে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সংগঠনগুলোর বেশিরভাগই এখনও গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চাদপসরণে, আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকার প্রশ্নের মুখে এবং দেশের রাজনৈতিক কেন্দ্র শূন্য হয়ে পড়ায় চরম ডানপন্থী দলগুলোর জন্য মাটি তৈরি হচ্ছে—তারা জোট ও মিত্রতার মাধ্যমে তাদের অবস্থান এবং আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পারছে।
যখন অনেক তরুণ এনসিপির মতো নবীন দলকে সমর্থন করছে এবং সংস্কার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছে, তখন তথাকথিত ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের’ প্রকৃত চরিত্র অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে। দেশ এখন গণতন্ত্র ও বিশৃঙ্খল পতনের মাঝামাঝি এক ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে বলে উল্লেখ করেছেন গবেষক আদিত্য গৌদারা শিবমূর্তি ও মধুরিমা প্রামাণিক।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) একটি স্বাধীন বৈশ্বিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। দিল্লির প্রধান কার্যালয় ছাড়াও ফাউন্ডেশনের মুম্বাই, চেন্নাই ও কলকাতায় তিনটি কেন্দ্র রয়েছে। ওআরএফ ভারতের সরকার, রাজনৈতিক মহল এবং ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জন্য নীতিনির্ধারণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক সম্ভাব্য উপাত্ত প্রদান করে ও নীতি ও পরিকল্পনার ভালোমন্দ নিয়ে বিশ্লেষণ করে।
ওআরএফ-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকের সংস্কারের প্রেক্ষাপটে ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে। তবে বর্তমানে এর কার্যপরিধি বিস্তৃত হয়েছে নিরাপত্তা ও কৌশল, শাসন ব্যবস্থা, পরিবেশ, জ্বালানি ও সম্পদ, অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধি পর্যন্ত।
ওআরএফ ধীরুভাই আম্বানি পরিবারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়; যদিও এটি দাবি করে যে তারা স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। কিছু প্রতিবেদনের মতে, ২০০৯ সাল পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের বাজেটের ৯৫% রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ দ্বারা প্রদান করা হতো, তবে এখন ধারণা করা হয় যে এই অনুপাত প্রায় ৬৫% এ নেমে এসেছে, কারণ ফাউন্ডেশন তাদের অর্থায়নের উৎস বৈচিত্র্যময় করেছে — সরকারের, বিদেশি ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য উৎসের মাধ্যমে।
একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যার লক্ষ্য হলো বিশ্বের সকল প্রান্তের কণ্ঠস্বরকে উৎসাহিত করা, ওআরএফ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে, যার মধ্যে অন্যতম হলো এর প্রধান বহুপাক্ষিক সম্মেলন ‘রাইসিনা ডায়ালগ’, যা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়। এই বার্ষিক সম্মেলনে বক্তা ও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থাকেন খ্যাতনামা সাংবাদিক, ব্যবসায়িক নেতা, নাগরিক সমাজের সংগঠক, পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি প্রতিনিধিরা — যাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত।
ওআরএফ ২০২০ সালের গ্লোবাল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইনডেক্স রিপোর্টে বিশ্বের শীর্ষ থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর তালিকায় ২০তম স্থানে স্থান পেয়েছিল। এই রিপোর্টটি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের থিঙ্ক ট্যাঙ্কস অ্যান্ড সিভিল সোসাইটিজ প্রোগ্রাম দ্বারা প্রকাশিত হয়। চীন, ভারত, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে ওআরএফ দ্বিতীয় স্থানে ছিল।
ভারতের বড় শহরগুলোতে আরও অনেক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা সরকারি নীতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছে। শুধু ভারতই নয়, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই সরকার কিংবা বিভিন্ন কোম্পানির আর্থিক সাহায্যে উচ্চতর গবেষণা, নীতি, পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের অধ্যাপক-পণ্ডিতগণ সেখানে কর্মরত রয়েছেন, যারা বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে মত প্রদান ছাড়াও কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির চিহ্নমাত্র নেই। এদেশের ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্বের বিষয়ে মোটেও মনোযোগী নয়। তাদের অধিকাংশেরই একমাত্র লক্ষ্য ব্যবসার মাধ্যমে অবাধে মুনাফা অর্জন করে বিদেশে পাচার করা। সরকারি পর্যায়েও বাংলাদেশে মানসম্পন্ন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিকাশ হয়েছে বলা যায় না।
এর ফল হয়েছে মারাত্মক। বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যু, যেমন সংস্কার, নির্বাচন, বন্দর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রোহিঙ্গা, জ্বালানি সম্পদ, পরিবেশ ও নগরায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিদেশে যত সিরিয়াস লেখালেখি ও নিবিড় গবেষণা হচ্ছে, বাংলাদেশে তেমনটি হচ্ছে না। এসব বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞও তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত নানা দেশের গবেষণা ও মনোভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ও এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাউন্টার ডিসকোর্স তৈরি করাও সম্ভব হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোও একদল অনুগত-লেজুড়-বুদ্ধিজীবী নামধারীর বাইরে যেতে পারছে না। যারা দল ও নেতার পেছন পেছন তাবেদারি করে কোনও পদ-পদবী বাগানোর জন্য, জাতীয় স্বার্থভিত্তিক আলাপ-আলোচনা ও গবেষণার জন্য নয়।
ভারতের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) তাদের নিজস্ব গবেষণার ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্র ও বিশৃঙ্খল পতনের মাঝামাঝি এক ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে’ মর্মে যে বয়ান উপস্থাপন করেছে, তা নিশ্চয় সর্বাংশে সত্য নয়। কিন্তু এই বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও তথ্যভিত্তিক জবাব দিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতি উপস্থাপনের জন্য তর্ক-বিতর্ক-গবেষণা কে করবে? কে বা কারা বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেশে-বিদেশে তুলে ধরবে? এসব বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য উপযুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা আদৌ সম্ভব হয়েছে?
যতক্ষণ এসব প্রশ্নের সদুত্তর না পাওয়া যাবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত ব্যবস্থা তৈরি না করা যাবে, ততক্ষণ বাইরের প্রস্তুতকৃত কিংবা চাপিয়ে দেওয়া বয়ান আমাদেরকে অক্টোপাসের মতো ঘিরেই রাখবে। লেখক – চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।