।। মনজুরুল হক।।
📍
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কনভিক্টেড। এরকম ব্যক্তির সঙ্গে সরকার প্রধানের বৈঠকের প্রোটোকল না থাকলেও ইউনূস নিজের স্বার্থে তা বানিয়ে নিয়েছেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন ঘোষণার পরে তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠক বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কী সেই উদ্দেশ্য?
📍
(১) হতে পারে এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণার পরে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বিএনপি এবং সেনাপ্রধানের ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে’ ঘোষণাটি অবজ্ঞা করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। এখন অন্যান্য দল কি করবে তার চেয়ে বড় কথা বিএনপি কি করবে? মুহাম্মদ ইউনূস জানেন বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন ইস্যুতে বেঁকে বসলে তার পক্ষে এপ্রিলে ঠেলে নেওয়া সম্ভব হবে না। তাই তারেক রহমানকে ‘ম্যানেজ’ করতে চাইছেন। তারেক যদি রাজি হয়ে যান তাহলে সেনাপ্রধানের আল্টিমেটাম ফাঁপা বুলি হয়ে যাবে। তাই সেনাপ্রধানকে বোঝানোর বা তার কাছে নতি স্বীকারের চেয়ে তারেক রহমানকে বোঝানো সহজ কারণ, তিনি মামলায় ফেঁসে আছেন। মামলাগুলোকে ‘টাইট দেওয়ার চাবি’ হিসাবে ব্যবহার করবেন ইউনূস। তারেক রহমানও মামলা তুলে নেওয়ার আশ্বাসে ইউনূসের নির্বাচন বিষয়ক ষড়যন্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করবেন।
📍
(২) হতে পারে নির্বাচনের আগেই জুলাই ঘোষণার চাল চেলে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রলোভন দেওয়া হতে পারে। সেখানে ইউনূস প্রেসিডেন্ট, তারেক প্রধানমন্ত্রী এবং জামাত-বিএনপি-এনজিও গ্যাংয়ের লোকজন দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে। সেই জাতীয় সরকার নির্বাচন বাতিল করে দীর্ঘ মেয়াদে দেশ শাসন করবে। দেশের আইন-আদালতের এখন যে অবস্থা তাতে তারেকের মামলাগুলো ভোজবাজীর মত উবে যেতে পারে। ইউনূস প্রেসিডেন্ট হলে তার মঞ্জিলে মকসুদ হাসিল হবে। বিএনপি-জামাতও বিনা নির্বাচনে পুরো একটা টার্ম ক্ষমতা ভোগ করতে পারবে। এতে করে বাকি চুনোপুঁটি দলগুলো শেয়ালের মত কিছুদিন হুক্কাহুয়া করে একসময় থেমে যাবে।
📍
(৩) হতে পারে বিএনপিকে ‘ইনক্লুসিভ নির্বাচন’-এর শর্ত থেকে ফিরিয়ে আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে বিএনপি-জামাতসহ বাকি দলগুলো ( ষাট-সত্তরটা প্যাড সর্বস্ব দল বানানো হবে) নির্বাচন করলে ইউনূসের কিংস পার্টি, বিএনপি, জামাত নিজ নিজ প্রয়োজনীয় আসন ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবে। ব্যাপারটা ‘আমরা আমরাই তো’-এর মত। সেজন্য সবার আগে বিএনপিকে রাজি হতে হবে তারা যেন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার দাবী না তোলে। হিসেব মতে বিএনপি সে দাবী তুলবে না। আগে প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানকে পদচ্যুত করা এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে বিএনপি ভেটো দিয়েছে। সেই বিএনপিই আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ হলে বলেছে-“১৮ কোটি মানুষের দাবী বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৮ কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না এবং দলটিকে নিষদ্ধ করা সমর্থন করে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে এই দাবী করে আসছিল, এবার তা পুরণ হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাই”।
📍
সুতরাং ইউনূস-জামাত-এনসিপির প্ল্যানে বিএনপির সায় দরকার। মুহাম্মদ ইউনূস সেই কাজটিই নিশ্চিত করার জন্য তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন।
📍
মুহাম্মদ ইউনূস প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী। ক্ষমতার জন্য তিনি করতে পারেন না এমন কাজ নেই। প্রয়োজনে দেশের মানসম্মান, আত্মমর্যাদা লুটিয়ে দিয়ে তিনি ক্ষমতা চান। প্রয়োজনে দেশের অংশ বিশেষ লিজ দিয়ে কিংবা বিক্রি করে হলেও ক্ষমতায় থাকতে চান। তিনি বুঝতে পারছেন তার ক্রিয়েটররা খুব বেশি দিন শুকনো আশ্বাসে সন্তুষ্ট থাকবে না। তারা দ্রুত ৫০ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্টের প্রতিদান চায়। সে জন্য মুহাম্মদ ইউনূসকে কমপক্ষে আরও দেড়-দু বছর ক্ষমতার শীর্ষে থাকতে হবে। সেটা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে হোক কিংবা প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
📍
মুহাম্মদ ইউনূস গত দশ মাসে এগার বার বিদেশ সফর করেছেন। তার মাত্র দুটি সফরে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন। বাকি সবগুলো সফর একান্ত ব্যক্তিগত সফর। যেগুলোয় যোগ দিতে বিশাল স্তাবক বাহিনী নিয়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা পয়মাল করেছেন কোনও বিবেক-বিবেচনা ছাড়াই। আত্মপ্রচারের জন্য রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা পানিতে ঢেলেছেন। নিজের করের ৬৬৬ কোটি টাকা দেওয়ার রায় বদলে জরিমানা মওকুফ করেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ৫ বছর পর্যন্ত কর রেয়াত করিয়েছেন, নিজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, রিক্রুটিং-এজেন্সি, অন্যান্য ব্যবসার লাইসেন্স হাতিয়েছেন। সেই মানুষটি সামান্য পুরষ্কারের আশায় রাষ্ট্রের আরও কোটি কোটি টাকা ঢেলে দেবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
📍
তারেক রহমানের সঙ্গে সকল বিষয়ে সমঝোতার সম্ভবনা প্রবল, কেননা খোদ বেগম খালেদা বিএনপি নেতৃবৃন্দকে ইশারা দিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দ্বিমত না করতে। তারেক রহমান সকল প্রস্তাবনা মেনে নেওয়ার পরও সংকট একেবারে শেষ হয়ে যাবে না। বিএনপি-জামাত-এনসিপি-ইউনূস একজোট হয়ে আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচন দুএকটি দেশ বাদে বাকি বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। উত্তর আসবে-তাতে ইউনূসের কিসসু আসবে-যাবে না। আসলে কি তাই? আসবে-যাবে না? হ্যাঁ আসবে-যাবে কারণ যে দেশগুলো দেশের বৃহত্তম দলকে নিষিদ্ধ ও অযোগ্য ঘোষণা করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা মেনে নেবে না তারা ইউনূসের বড় অংশের অর্থের যোগানদাতা। অর্থ অবশ্যই ম্যাটার করে। করবেও। এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য মুহাম্মদ ইউনূসকে নির্বাচন ভণ্ডুল করতে হবে। তিনি এবং তার সরকার সেই দুঃসাহসীক কাজটি করতে গেলেই বিএনপির সায় লাগবে।
📍
বিএনপি সেটাতেও সায় দেবে যদি শাসনক্ষমতার অংশীদারিত্ব পায়। এবং সেই অংশীদারিত্বই হচ্ছে ‘জাতীয় সরকার কনসেপ্ট’।
📍
এর মধ্যে আরও একটি বিষয় মুহাম্মদ ইউনূসের ঘুম হারাম করে দিতে পারে। তা হলো জুলাই প্রক্লেইমেন্ট ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই মুহাম্মদ ইউনূস গং প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন ও জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে বহিষ্কার করতে চাইবে। সেটা ঘটার আগে ক্ষমতাহীন প্রেসিডেন্ট হয়ত কোনও ভূমিকা নিতে পারবেন না, তা বলে জেনারেল ওয়াকারও কি বসে থাকবেন? নিজের পরোয়ানা প্রচার হতে দেখবেন? মনে হয় না। যদি এই ‘জাতীয় সরকার কনসেপ্ট’-এর সঙ্গে তিনিও জড়িত থাকেন তহলে আল্টিমেটাম আল্টিমেটামের জায়গাতেই থাকবে, ইউনূসের কাজ তার ইচ্ছামতই হতে থাকবে। তা যদি না হয় তাহলে জুলাই প্রক্লেইমেন্ট ঘোষণার আগেই জেনারেল ওয়াকার হয়ত অ্যাকশনে নামবেন। এটা ঘটলে সে সময়কার স্ট্রাটিজি কী হবে সে আলাপটাও তারেক রহমানের সঙ্গে সেরে নেবেন মুহাম্মদ ইউনূস।
📍
যা হোক, দেশের ভাগ্যাকাশে এখন জমাট মেঘ। সাইক্লোন, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস যা খুশি হতে পারে। আর সেটা এই জুলাইতেই। হয় জুলাই ঘোষণার মৃত্যু হবে, নয়ত বাংলাদেশটারই মৃত্যু হবে।