।।আলি শরিয়তি উবাচ।।
দেশবাসীকে জানানো হয়েছে, ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করতে প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন সফর করছেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মূলত তিনি কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন এবং বিএনপি কতদিন অনুমোদন করবে, এই ফয়সালা করতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন সফরে রয়েছেন। কারণ লন্ডনেই পলাতক জীবন যাপন করছেন বিএনপি নেতা তারেক রহমান। এজন্য সেখানেই দুজনের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে এবং বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করবে দুজন ষড়যন্ত্রকারীর বৈঠকের ফলাফল।
দুজন নীতিহীন, দুর্নীতিবাজ, উগ্রবাদের নেতা, সাম্রাজ্যবাদের দালাল যখন এক টেবিলে বৈঠকে বসবে, সেখানে মঙ্গলের বিপরীতে অমঙ্গলের কালোছায়াই উৎপাদিত হবার কথা। এটাই রাজনৈতিক সায়েন্স, এটাই স্বাভাবিক।
আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে পৃথিবীর সকল ষড়যন্ত্রের বৈঠক লন্ডন, সিঙ্গাপুর, দোহা ও দুবাইতে অনুষ্ঠিত হয়। অন্য ভেন্যুগুলো সকল ক্ষেত্রে গুরুত্ব ধরে রাখতে না পারলেও লন্ডন তার গুরুত্ব ও উপযোগীতা ধরে রেখেছে। প্রয়াত জাতীয় নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একবার বলেছিলেন, লন্ডন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ও কুখ্যাত মানুষের আশ্রয়স্থল এবং মঙ্গল ও ষড়যন্ত্রের কারখানা।
প্রয়াত রাজনীতিক ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী বলেছিলেন, বাংলাদেশের সকল ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক বিদেশে, বিশেষ করে লন্ডনে হয়। দেশের ভেতরে কোন ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক হয় না। এরকম একটি ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক হতে যাচ্ছে ড. ইউনূস ও তারেকের মধ্যে এবং লন্ডনে।
ইউনূসের ক্ষমতারোহণঃ
একটি পূতিগন্ধময় ও রক্তাক্ত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, টাকাপাচার, একনায়কত্ব ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন; ইত্যাদির মতো অভিযোগ থাকলেও এসব নিয়ে ইউনূস সরকার কোনরকম বিকল্পপন্থা দেখাতে পারেনি। সংস্কারের নামে নির্বাচনে সময়ক্ষেপণ, বন্দর ইজারা, রাখাইনে মানবিক করিডোর এবং ইউনূসের নিজের ব্যবসা বৃদ্ধি এখন পর্যন্ত অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসী ও জ#ঙ্গিদের মুক্তি দেয়া, অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা জনজীবনে অশান্তি ব্যতিরেকে স্বস্তির কোন উপাদান হাজির করতে পারেনি ইউনূসের শাসনকাল। দেশকে চূড়ান্তভাবে বিভাজিত করার ঘৃণ্য কর্মের কৃতিত্বও জেনারেল জিয়ার পরে অধ্যাপক ইউনূসকেই দিতে হবে!
বিএনপির অবস্থানঃ
মিটিং করতে তারেক রহমানের অনীহা ছিল, স্থায়ী কমিটিও ভেটো দিয়েছিল। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপে ও ইচ্ছায় মিটিং হচ্ছে। গত ১১ জুন জামায়াত-হেফাজত ও এনসিপি ত্রিদলীয় মিটিং করে ইউনূস-তারেক, এই দুজনের বৈঠকের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সূতরাং নির্বাচন নয়, অনির্বাচিত উপায়ে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতেই ইউনূসের এই বৈঠকের নাটক। শুধু নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করতে ইউনূসের লন্ডনে গিয়ে ঢোল পিটিয়ে তারেক রহমানের সাথে বৈঠকের দরকার হয় না। জুলাই সনদ, ১৯৭২-এর সংবিধান বদলে ফেলে রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টে ফেলা, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা, আরাকানে করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল ইজারা প্রভৃতি নিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর লোভ দেখিয়ে একটি চুক্তি করা এই বৈঠকের নীলনকশা হতে পারে।
বিএনপি কি ড. ইউনূসের এই অসৎ উদ্দেশের সারথী হতে যাচ্ছে? যদি তাই হয়, তবে মনে রাখতে হবে ড. ইউনূস হলেন সেই বান্দর (বাঁদর), পিঠাভাগের পর দেখা যাবে সব তাঁর পেটেই যাবে। বিএনপি বাঘের থাবা না দিতে পারলে বিএনপির কপালে কিছুই জুটবে না। এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়।
যদিও বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বৈঠক আগামী জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচন-সংস্কার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ রিজভী আরও বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন। তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের মতো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংলাপ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।‘ রিজভী সাহেব মুখের জোরে বলেছেন বটে, কিন্তু ড. ইউনূস কিন্তু আল-জাজিরার সাংবাদিকের পাল্টা প্রশ্নের পর থেকে ‘শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন’ এসব ফালতু কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটি একটি ফালতু ও মিথ্যা অপপ্রচার হিসেবে প্রমাণিত।
বিএনপির টার্গেট ক্ষমতায় যাওয়া, ইউনূসের টার্গেট ক্ষমতায় টিকে থাকা। এই সূত্র ও দুইপক্ষে উদ্দেশ্য একবিন্দুতে মিলে গেলেই তাঁদের বৈঠককে সফল বলা যাবে। আর তারা সফল হলে বাংলাদেশ পরাজিত হবে এবং সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক দেশে পরিণত হবে প্রিয় স্বদেশ, আমার সোনার বাংলা, আমাদের বাংলাদেশ।
ফলাফলঃ
ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য গোপন বৈঠকে- ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ভেঙে সংশোধিত সাংবিধানিক মডেলের অধীনে তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী এবং ইউনূস নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বসানোর জন্য একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রস্তাব করতে পারেন। এতে দুই পক্ষই সফলতার আলো খুঁজে পাবে।
এছাড়াও বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন নামক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগির ব্যবস্থা নিশ্চিত হতে পারে। একইসাথে ১৯৭৯ মডেলের একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়েও ফয়সালা হতে পারে। বৈঠকের পরিবেশ ইউনূসের অনুকূলে থাকলে জুলাই সনদ নিয়েও আলোচনা হবে এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।
ড. ইউনূসের এসব দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নের প্রধান বাধা রাষ্ট্রপতি ও তিনবাহিনী প্রধান। বিএনপিও এই বাধার অংশ ছিল বলে মনে করা হয়। যদিও তারা ক্ষমতার অংশীদার এবং পুরো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এই বৈঠকে হয়ত রাষ্ট্রপতি ও তিনবাহিনীর প্রধানকে অপসারণের বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা হতে পারে।
রাজনৈতিক হিসাবের বাইরে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা দেয়া। যে কারণে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকেও ডেকে নেয়া হয়েছে। এই বিষয়ে ইউনূসের অবস্থান পরিস্কার এবং বিএনপিকেও তিনি একই অবস্থানে থাকা নিশ্চিত করতে চায়। এক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব ও ভাগাভাগি নিশ্চিত করবে।
এরকম নানামুখি ষড়যন্ত্র সফল করতে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে শুরু থেকেই পশ্চিমা কূটনৈতিক শক্তিগুলি এই সংলাপকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করেছেন। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কোন অপশক্তির ইচ্ছায় ও আগ্রহে এই বৈঠক হচ্ছে।
বিএনপি যদি রাজনৈতিক দল হয়, তাহলে ইউনূসের পাতা ফাঁদে পা দিবে না। আর যদি পুরানো অবস্থান অর্থাৎ, সুবিধাবাদীদের ক্লাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে থাকে তাহলে ইউনূসের পাতা ফাঁদে পা দেওয়াই স্বাভাবিক।
এখানে আমরা প্রয়াত রাজনীতিক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে স্মরণ করতে পারি। তিনি বলছিলেন, ‘দুই নারীর মিলনে কিছুই হয় না’। তবে দুই শয়তানের মিলনে তৃতীয় শয়তান বায়োলজিক্যালি জন্ম নেবার চান্স থেকেই যায়। কারণ শয়তান সায়েন্স মানে না। ফলে দুই শয়তানের মিলনে তৃতীয় শয়তান পয়দা হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এসবের সঠিক উত্তর দিতে পারবে একমাত্র ‘সময় এবং সময়’। সে-জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।