।। আফজাল হোসেন।।
দেশটাকে ধরে নেই একটা বাড়ি। সে বাড়িটাতে আমরা বাস করি। বাস করি বলে দাবী করতে পারি, বাড়ি বা দেশটা আমাদের। যা যা আমরা ফ্রী-তে পাই, কোনোটাই নিজের বা নিজেদের নয়। যেমন আমরা খুবই উচ্ছাস নিয়ে বলে থাকি, আমাদের আছে চমৎকার একটা আকাশ। তা মনের একটা ভাব প্রকাশ করা। আসলে আকাশ আমাদের নয়।
আকাশ আমরা নিখরচায় ভোগ করতে পারি, যেমন ভোগ করি বাতাস। ছোটবেলায় নদীতে সাঁতার কেটেছি, বলতাম- আমার নদী। বলে ভালো অনুভব করতাম, তাই বলেছি। নদী যদি আমাদের হতো, অযত্নে অবহেলায় জোয়ার ভাটার নদী এমন শুকিয়ে যেতো না।
এমন বহুকিছু রয়েছে, আমরা আমাদের বলে দাবী করতে দ্বিধা করি না। বন্ধু নিয়ে গর্ব করি অনেকেই, কতজন বন্ধুত্বের মানে খুঁজতে অন্তত একদিন গভীরে গেছি? সে, তারা আমার বন্ধু বলে বলে সুখের স্বাদ পাই, সে আধা স্বাদে সন্তুষ্ট থেকে পুরো জীবন কাটিয়ে দেই।
তুমি আমার, তোমাকে পাওয়া মানে, পুরো জগতটাকে নিজের করে পাওয়া- প্রেমের মাধুর্যে সয়লাব হয়ে থাকলে এমন করে সবাই ভাবে। ঐ ভাবনায় ভেসে থাকা প্রেমের সবটুকু নয়। ভাসার আনন্দে সন্তুষ্ট মন , ডোবার আনন্দ বঞ্চিত থাকে।
নিয়মিত আমরা বলে থাকি- তুমি আমার, সে আমার, দেশ আমার। অনুভূতি প্রকাশের এমন ভাষার মধ্যে প্রেমময়তার চেয়ে বেশি থাকে দখলদারিত্ব।
একটা বই- লেখক লেখেন, প্রকাশক প্রকাশ করেন। পয়সা দিয়ে কিনে আমরা দাবী করি, বইটা আমার। বইটা শুধু ঘরের শোভা বাড়ানোর জন্য শেলফে সাজিয়ে রাখা হলে- সেটা ঘরের বই, শেলফের বই। বইটা পাঠ করলে, পৃষ্ঠায় যা লেখা তা পৃষ্ঠা থেকে উঠে মনের মধ্যে ঢুকলে- তখন হয় নিজের। তখন দাবী করা শোভন হয়- আমার বই।
নিজেকে বদলানোর মানসিকতা, সাধ ও সাধ্য যাদের থাকে- তারা বইয়ের মতো দেশকেও পাঠ করতে চায়। সে আগ্রহ থাকলে, অন্তর দিয়ে দেশকে অনুভবও করা যায়। মনে দেশের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা জন্মায়। মনে প্রশ্ন জাগে- কি আমার কর্তব্য, দেশের জন্য কি করতে পারি বা করি আমি? যে মনে প্রশ্ন জাগে, সে মন উত্তরও পেয়ে যায়।
আমি আমি র অনুভব বাদ দিয়ে আমরা আমরা র অনুভব অর্জন করতে না পারলে- তা মুখে মুখের দেশপ্রেম। যে আমরা আমরা দেশ দাপিয়ে বেড়ায়- তা দল, দলপ্রেম। নিষ্ঠা নেই, নেই ত্যাগ করতে পারার মন মানসিকতা, ছোট বড় মানুষের প্রতি সমান শ্রদ্ধা নেই- এমন বহু মানুষ যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষদের সুখ শান্তি হরণ করে দেশের প্রতি প্রেম জাহির করে চলেছে। তা প্রেমহীনতা, সকলের জন্য যাঁতাকলের অত্যাচার- পিষে চলেছে, গুঁড়ো করে ফেলছে সাধারণের জীবন।
আমরা যে অনেকেই দেশটাকে আমার, আমাদের বলে দাবী করে থাকি, তা উত্তরাধিকারসূত্রে বাপ দাদার জমিজমার ভাগ পাওয়ার মতো। ভাগের সম্পত্তি ছাড়া নিজেদের কোন যোগ্যতা, ভূমিকার কারণে ভাবা যেতে পারে- দেশটা আমার বা আমাদের? যারা যুদ্ধে গিয়েছিল, দেশ এনে দিয়েছে তারা কিন্তু নিজেদের স্বপ্নের দেশটাকে পায়নি। যারা প্রানদান করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেনি বেঁচে থাকারা।
আমরা অন্যের দোষ ধরতে পারি, নিজ নিজ রাজনৈতিক অনুগত্যের কারণে দা, লাঠি, পিস্তল হাতে রাস্তায় নেমে পড়তে পারি। এই নেমে পড়া কি দেশপ্রেম? নিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু ঘটলে- দেশ গোল্লায় চলে যাচ্ছে ভেবে ফেললাম। যার সঙ্গে মত ও পথের মিল নেই- ধরে নেই জন্মেরশত্রু সে। বিপরীত মতের, পক্ষের যারা নয়, ভেবে ফেললাম- তারা দেশের নয়। তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, হিংসা ছড়ালাম- খতম করে দেয়ার সাধ জাগলো মনে, এসব দেশপ্রেমের উদাহরণ নয়।
দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতি কম দেখা হয়নি। আমরা দেখেছি, জানা বোঝা, নিষ্ঠাবান মানুষেরা নিজ দলেই পায়ের তলায় মাটি পান না- প্রশ্রয় পায় বেয়াড়ারা। দলগুলো যেনো বেয়াড়া তৈরির কারখানা। যে যতো বেশি বেয়াড়া, তার ততো দাম। দাম মেলে বলে, আমি অমুক দলের বলে হুঙ্কার দিয়ে নিজের গুরুত্ব, জোর জানাতে, বোঝাতে চাওয়া ভন্ড মানুষ কালে কালে দেশবাসী উপহার হিসাবে পায়।
অন্যায় করে ন্যায় ভাবা, মানুষের অধিকারের তোয়াক্কা না করা- এসব স্বেচ্ছাচারিতা লালনপালন করা মন সুস্থ নয়, স্বাভাবিক নয়। নিজের অজ্ঞানতা অনুভব করার সাধ্য নেই কিন্তু দোষ ধরতে জানে ষোলো আনা- বউ পেটানো স্বামীদের মতো স্বভাব। এই স্বামীরা বাড়ি আমার, সংসার আমার বলে- বলে বউ আমার।
আমার বলে ভাবা আর সত্যি সত্যি আমার করে তুলতে পারার মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল- আত্মতুষ্টিতে চোখ বন্ধ করে রাখা মানুষ সে পার্থক্য টের পায় না। স্বার্থপর মানুষ বিত্ত বৈভব হয়তো অনেক অর্জন করে কিন্তু “নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে” ধরণের জীবন প্রাপ্ত হয় তারা। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে মন প্রান ডুবিয়ে সুখ ভোগ করতে দেন, দেন না জীবন, মানুষ বুঝতে চাওয়ার আগ্রহ।
মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে জীবন বুঝলাম না, মানুষ বুঝলাম না, বুঝতে পারিনি প্রেম কি, দেশ কাকে বলে? এ কেমনতর মানুষ আমি বা আমরা? এমন মানুষেরা যে দেশটাকে পায়, যেভাবেই পাক, মর্ম বোঝে না। মর্ম না বোঝা মানুষেরা দেশ পায়, দেশাত্মবোধ পায় না।