।। কবির য়াহমদ।।
কে কোথায় কোন ‘মাফিয়া বাহিনী’ দ্বারা আশ্রিত বা পুনর্বাসিত, এসব দাবি-প্রচারণা ধর্ষকের অপরাধকে হালকা করে। ধর্ষককে ধর্ষক হিসেবে দেখে, সমাজকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, প্রশাসনকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
কুমিল্লার মুরাদনগরের ধর্ষণের ঘটনা ঘটল গত বৃহস্পতিবার। শনিবার রাতে ফেইসবুকে ভাইরাল হলো একটা ভিডিও। এরপর সবাই জানতে পারে ধর্ষণের কথা। এর আগে শুক্রবার দুপুরে থানায় ভুক্তভোগী নারী মামলা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা তো দূরের কথা, সংবাদমাধ্যমেও তেমন গুরুত্ব পায়নি। অনাহূত হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার কারণে বিষয়টি সবার নজরে আসে। সকলেই ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়। এরপরই ধর্ষক ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুক্তভোগী নারীর যে অবস্থা দেখা গেছে, এটা অব্যাখ্যেয়। অসহায়ত্ব, বাঁচার আকুতি সব ছিল। কিন্তু ধর্ষক ও তার ভিডিও ধারণকারী দুর্বৃত্তদের থেকে ভুক্তভোগী নারী রক্ষা পাননি। ভিডিওটিতে ওই নারীকে মারধর করতেও দেখা যায়। এই মারধর করা লোকজন স্থানীয়। নারী সর্বক্ষেত্রে ভিক্টিম, ধর্ষণের শিকার হলে সে যেমন ভিক্টিম, একইভাবে সমাজের চোখে অপরাধী। স্থানীয়রা ওই পূর্বধারণা থেকে মারধর করেছে নারীকে।
আচ্ছা, ভিডিওটি যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ত, তবে কি ধর্ষক ও ভিডিও ধারণকারীরা গ্রেপ্তার হতো? এই প্রশ্ন তুলতে চাই। ভিডিও যদি ছড়িয়ে না পড়ত, তবে কি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এটা নিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিতেন। যদিও তিনি এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতিকে টেনে এনেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার রাজনৈতিক বিরোধিতাকারীদের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে টেনে এনেছেন।
আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, “মুরাদনগরে সব আওয়ামী সন্ত্রাসীদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, পুনর্বাসন এবং ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়েছেন—আজকের পরিস্থিতির জন্য তারাই দায়ী। এর আগেও চাঁদাবাজকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করায় তাকে ছিনিয়ে নিতে থানায় হামলা-ভাঙচুর করে এক মাফিয়ার বাহিনী। আজকে আমি লজ্জিত, আমার বলার ভাষা নেই। এলাকার লোকজন দেখা হলেই বলে গণ-অভ্যুত্থানে দেশ মুক্ত হয়েছে কিন্তু মুরাদনগর আরও বড় মাফিয়াদের দখলে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন ধর্ষকদের গ্রেপ্তার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে মূল মাফিয়াদের লাগাম টেনে না ধরা গেলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”
ভাষাহীন আমরা! ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক একটা ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের প্রসঙ্গ তুলে আনাকে কি দায়িত্বশীলতা বলে? আমি অন্তত সন্দিহান!
আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) জানুয়ারি-মে ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী এই সময়ে কেবল ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে ৩৮৩টি। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে ৯৭টি। ধর্ষণের পর হত্যা হয়েছে ১৬টি; ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা ৫; ধর্ষণ প্রচেষ্টার পর হত্যা ৩; ধর্ষণ প্রচেষ্টার সংখ্যা ১৫০। আইন ও সালিস কেন্দ্রের এই তথ্য কিছু সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া। ফলে ধারণা করা যায়, প্রকৃত সংখ্যা আর তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখিত সংখ্যার পার্থক্য অনেক। সংস্থাটি জানিয়েছে পৌনে চারশর বেশি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে অন্তত ৭১টি আইনি প্রতিকারের পথে যাওয়ার তথ্য নেই।
সন্দেহ নেই এটা দেশব্যাপী নারী নিপীড়নের পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। এটা প্রকাশিত তথ্যের একটা অংশ। এর বাইরে আছে প্রকাশের বাইরের চিত্র, রয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থার দৃষ্টির আড়ালে থাকা তথ্য। একইসঙ্গে রয়েছে নারীর ওপর পারিবারিক ও সমাজস্থদের নির্যাতন-নিপীড়নসহ আরও অনেক ক্ষেত্র। মাত্র পাঁচ মাসের প্রকাশিত এই তথ্য বলছে, এই সময়ে দৈনিক ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা দুইয়ের বেশি। ভয়াবহ। ভয়াবহতার আরও বড় বিষয় হচ্ছে কোনো কিছু ভাইরাল না হলে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। এই ভাইরাল বিষয়টি যদিও আইন-বিরুদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য।
মুরাদনগরের ধর্ষণের শিকার নারী ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’। ‘সংখ্যালঘু কার্ড’ এখানে ভালো রূপে প্রতিষ্ঠিত। এটাকে একদল লোক ভিক্টিমের দুর্বলতা ভাবে, আরেকদল লোক এটাকে উপলক্ষ হিসেবে বেছে নেয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হওয়ার পর একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছিল যে, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কেউ কোথাও আক্রান্ত হয়নি, হয়েছে ‘রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে’। ওই সময় সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরাও এমন প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ফলে অপরাধের মধ্যে ‘ভালো অপরাধ’ আর ‘খারাপ অপরাধ’ রূপে একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করা হয়েছিল।
মবকে যখন প্রেশার গ্রুপ বলা হয়, ধর্ষণের পেছনে রাজনীতি খোঁজা হয়, সেটা কি হিতে-বিপরীত হয়ে পড়ে না? শুধু তাই নয়, সরকার-সমর্থিত ফ্যাক্ট চেকাররা প্রশ্ন তুলছেন, মামলা করতে এত দেরি হলো কেন? ওইদিনের ঘটনা যদি ‘ধর্ষণ’ নাও হয়ে থাকে বলার পর কিছু যদি-কিন্তুর সমাহার তৈরি করেন, তখন বড় অপরাধ ছোট হয়ে আসে। আমরা জানি, হিন্দুদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের জন্য, দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্রটি হচ্ছে, ধর্ষণ। ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর কয়েকটি গ্রামে হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, সেই নারীদের কোনো পরিবার আর দেশে নেই। তাদের দেশত্যাগের ঘটনাগুলো কিন্তু ঘটেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। হিন্দুরা কারো কাছে ভোটের অংক, কারো কাছে জমিজমার বাড়াবার উপায়।
ধর্ষক ফজর আলীর রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হচ্ছে। একদল লোক তাকে বিএনপির লোক বলছে, আরেকদল বলতে চাইছে সে আওয়ামী লীগের লোক। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ফেইসবুক স্ট্যাটাসের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বিষয়টির পালে আরও হাওয়া লাগিয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যেখানে জীবন বিপন্ন অনেকের, সেখানে ধর্ষণে প্রবৃত্ত হওয়া কি ঝুঁকির নয়?
ধর্ষণের পেছনে কাজ করে যে মনস্তত্ত্ব তার প্রধান প্রপঞ্চ হচ্ছে নারীকে দুর্বল মনে করা। নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করার পুরুষতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তকে ব্যক্তির চিন্তার দৈন্য ও অক্ষমতা হিসেবেও চিত্রিত করা যায়। অনেকের কাছে নারী মানে ভোগ্যপণ্য; এর একটা ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণাও আছে দেশে এবং এটা করা হয় ধর্মীয় আবরণে। এসবের দ্বারা অনেকেই প্রভাবিত হয়। এই প্রভাব আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মুরাদনগরে যেখানে ধর্ষক ফজর আলী দরজা ভেঙে ঘরে একা পেয়ে নারীকে ধর্ষণ করে। এখানে যেমন তার বিকৃত যৌনকামনা, বিকৃত যৌনচিন্তা রয়েছে, তেমনি রয়েছে ক্ষমতা প্রদর্শনের অভীপ্সাও। প্রতিবেশী যারা ভুক্তভোগী নারীকে মারধর করেছে এবং ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে, তারাও একইভাবে নারীর প্রতি ভুল ধারণায় বেড়ে ওঠা লোকজন।