গত বছরের ৫ই আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে ‘মব সন্ত্রাস’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংস হামলা এক ভয়াবহ সংকটের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, এমনকি সরকারি কর্মকর্তা-কেউই এই মব সন্ত্রাসের কল থেকে মুক্ত নন।
পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশে যত মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে চলেছে, তার নেতৃত্বে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে জুলাই-আগস্টে সহিংসতা ও নাশকতায় অংশগ্রহণকারী গোষ্ঠীগুলো। ড. ইউনূসের ভাষ্যে- তার নিয়োগকর্তারা, যারা ইউনূস-সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী।
এদের মধ্যে রয়েছে- বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর গুপ্ত সন্ত্রাসী সংগঠন- শিবির, কিংস পার্টি খ্যাত এনসিপি, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের কর্মী ও বৈছা আন্দোলনকারী। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সারা দেশের কয়েক শ কিশো গ্যাং।
কাউকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো, ব্যবসা-বাড়িঘর উচ্ছেদ করা বা অনৈতিক ফায়দা আদায়ের জন্য টার্গেট করে কাউকে আওয়ামী লীগের দোসর বা ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যায় কিংবা ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগ তুলে হামলে পড়ে মারধর, নির্যাতন, হামলা-ভাঙচুর-লুটপাটের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে সরকার-সমর্থক উপরোক্ত গোষ্ঠীগুলো। কখনো তৌহিদি জনতার নামে, কখনো ছাত্র-জনতার নামে এসব মব সন্ত্রাস ঘটানো হচ্ছে।
আগস্টের পর সারাদেশে সরকারি বুলডোজার ব্যবহার করে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক কার্যালয়, ঐতিহাসিক স্থাপনা-ভাস্কর্য ইত্যাদি ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই এসব ঘটেছে। কিন্তু ইউনূস-সরকার এতে বাধা দেয়নি। গাজীপুরে সাধারণ মানুষ এমন একটি মব সন্ত্রাস প্রতিহত করতে গেলে সরকারি মদদপুষ্ট কয়েকজন মব সন্ত্রাসী আহত হয়। এতে উল্টো সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলার প্রেক্ষিতে চলে ব্যাপক ধরপাকড় ও গ্রেপ্তার বাণিজ্য।
সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে মব সন্ত্রাসের বলি হয়েছে মা-ছেলে-মেয়েসহ এক পরিবারের চারজন। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেখানে খলিলুর রহমানের পরিবার তার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি, ছেলে রাসেল মিয়া এবং মেয়ে জোনাকী আক্তার মোবাইল চুরির সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে সমাজে আইনের শাসন না থাকা এবং প্রশাসনের উদাসীনতা, ব্যর্থতা ও কোথাও কোথাও সরকারি মদদ।
রাসেল মিয়ার স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, “এমন ঘটনা শোনার পরও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি মানুষ মানুষকে এভাবে পিটিয়ে মারতে পারে।”
কিন্তু কুমিল্লা পুলিশ সুপার (এসপি) নাজির আহমেদ খান জানিয়েছেন হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশ কাজ করছে, তবে ঘটনাটির পরবর্তী একদিনে এ পর্যন্ত কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। এটি সরকারের ব্যর্থতার আরেকটি চিহ্ন। এভাবে মব সন্ত্রাসীরা আস্কারা পাচ্ছে এবং এ ধরনের অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।
একইভাবে, গত রোববার গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে চোর সন্দেহে ১৯ বছর বয়সী পোশাক শ্রমিক হৃদয়কে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চুরির অভিযোগে রশি দিয়ে বেঁধে উপুর্যপুরি পেটানো হয় তাকে। এই ঘটনার পরেও পুলিশ অভিযান চালিয়ে কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে, তবে জনগণের মধ্যে শঙ্কা বাড়ছে যে, গণপিটুনির ঘটনা দ্রুত বাড়ছে এবং অপরাধীরা প্রতিদিনই আইনের হাতে শাস্তি পাচ্ছে না। আটকের পরেও ন্যায়বিচার মিলবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় ভুক্তভোগীদের স্বজনদের।
কুমিল্লার ঘটনাটি এখন সামাজিক অস্থিরতা এবং আইনের শাসনের অবমাননার বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষত পুলিশ বিভাগের উদাসীনতা ও ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়।
পুলিশ প্রধান বাহারুল আলমও স্বীকার করেছেন যে, পুলিশের একার পক্ষে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলির মতে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২৫৩টি মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনাগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থা এমএসএফ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু জুন মাসেই ৪১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে, যার ফলে ১০ জন নিহত ও ৪৭ জন গুরুতর আহত হন।
এদিকে, রাজনৈতিক বিরোধ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে মব সন্ত্রাসের ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।”
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের যে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক এবং অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়ছে। সরকারের উচিত ছিল কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনা, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এই অবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি সরকারের ব্যর্থতার প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং দাবি তুলেছে, মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক কোনও সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং এনসিপি, বিএনপি ও জামায়াত ও ধর্মীয় দলগুলোর অব্যাহত প্রভাবের কারণে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ব্যর্থতায় দেশের সাধারণ মানুষ এখন এক ভয়াবহ অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, যেখানে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া একটি পরিণতি হয়ে উঠেছে।