।। জাহানারা নুরী।।
জুলাই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে তথাকথিত “কোটা আন্দোলন” দেখা গেছে, তা শুধুমাত্র একটি শিক্ষার্থীবান্ধব দাবি ছিল — এই বয়ানটা যতটা আবেগময়, বাস্তবে এটি ততটাই রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক ও অগণতান্ত্রিক। এটা সময় এসেছে দৃঢ়ভাবে বলা: এই আন্দোলন ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক ছদ্মবেশী অভ্যুত্থানের অংশ, যা গঠনমূলক নয় বরং রাষ্ট্র ও সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। জুলাইয়ের কোটা আন্দোলন” অবৈধ, অন্যায়মূলক এবং রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক এক দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী করেছিল। এবং তাতে দেশী বিদেশী নিওলিবারেল লয়ালিস্টরা অংশগ্রহণ করে।
“কোটা সংস্কার” নয়, জুলাই ছিল সিস্টেম ভাঙার ছদ্ম দাবী। “কোটা সংস্কার” শ্লোগানটি আবেগায়িত হলেও আন্দোলনকারীদের কার্যক্রম, নেতৃত্ব এবং শেষপর্যন্ত তাদের “এক দফা” দাবির ঘোষণাই প্রমাণ করে — এটি ছিল রাজনৈতিক এজেন্ডা-চালিত একটি আন্দোলন।
স্লাভয় জিজেক (Slavoj Žižek) একে বলতেন “pseudo-emancipatory demand” —
যেখানে একটা দাবির পেছনে থাকে আসল উদ্দেশ্য: ক্ষমতা কাঠামোকে অস্থিতিশীল করা।
বুর্দিয়ুর (Pierre Bourdieu) ভাষায় বলতে গেলে জুলইতে আমার দেখেছি সেই “Symbolic Violence ” —যা জুলাইতে শুরু হয়ে গত এক বছর ধরে জাতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ওপর চলমান রয়েছে।
অর্থাৎ, মুষ্টিমেয় গ্রাম ও শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রজন্মের একটা ক্ষুদ্র অংশ নিজেদের সুবিধা আদায়ে রাষ্ট্রের নীতির উপর চাপ প্রয়োগ করছে, অথচ বিপুল সংখ্যক গরিব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করছে না। যারা তাদের স্বাতৃথ রক্ষা করে বলে নিজেদের জাহির করেছে এতকাল, তাদের প্রজন্ম এই বাচ্চাদেরই পাশে দাড়িয়ে জুলােইয়ের দাঙ্গাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে চলেছে।
২.
জুলাইয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিশেষে প্রতিষ্ঠান বা নীতি বিরোধিতা নয়, রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি ভাঙার চেষ্টা, এর বাইরে কিছু নয়। কোন রাষ্ট্রটি ভাঙ্গার প্রয়াস? যে রাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের বিপুল সাহস, ত্যাগ, লড়াইয়ের মাধ্যমে, বহু যুগ ধরে অনুন্নত, জাতি ও গোষ্ঠী-ঘৃণার শিকার, শোষণ, বঞ্চনা, অপমান ও অপবাদে-ভোগা, পূর্ববাংলার বাঙ্গালীর মহাকাব্যিক উত্থানের পথ ধরে জন্ম নিয়েছে ও নির্মিত হয়েছে। তার সেই উত্থানকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলের কলোনীর চর্ব-চুষ্য-লেহ্য-পেয় পাওয়া আশরাফ মুসলিমদের সন্তানেরা, যারা ১৯৭১ এ বাঙ্গালী বলে এথনিক ক্লিনজিংয়ের বল হয়েছিল, আজ যা কিছু ধ্বংস করছে তা বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ধারাকে ধারণ করে বলেই ধ্বংস করছে।
বিক্ষোভের নামে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস, এবং প্রশাসনিক ভবন অবরোধ – এগুলো কি কোনো দায়িত্বশীল সামাজিক আন্দোলনের অংশ?
অ্যান্টোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci) বলেছিলেন, যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে একটি আন্দোলন “বিপ্লবের” নামে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা শুরু করে, তা একপর্যায়ে “passive revolution”-এ রূপ নেয়, যার শেষ হয় চরমপন্থা দিয়ে।
কোটা আন্দোলনে ঠিক তা-ই দেখা গেছে — শিক্ষার্থীদের ব্যানারে গড়ে ওঠা একটি সুশৃঙ্খল গণআন্দোলন হঠাৎই হয়ে ওঠে এক দফার ক্ষমতাচ্যুতির ডাকে।
৩.
জুলাইয়ের বিতর্কিত নেতৃত্বের লুকোছাপা, নিজের পরিচয় লুকানোর চেষ্টা ও রাজনৈতিক স্লোগানগুলোর ধরণ তাদের উদ্দেশ্য প্রকাশ করেছে।
যে সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে
কেউ কেউ জামায়াতপন্থী ছাত্র রাজনীতির ঘনিষ্ঠ,
কেউবা অতীতে বিএনপি ও ডানপন্থী এজেন্ডায় সরব ছিল,
আবার কেউ ‘শিক্ষার্থীর’ মুখোশে ‘প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক শক্তি হস্তান্তরের ভাষ্য’ তৈরি করেছে।
এখানে আমরা দেখতে পাই জ্যাক লাকান (Jacques Lacan) যে “Master’s Discourse”-এর কথা বলেন —
অর্থাৎ আন্দোলনের মাধ্যমে “অপর” (শাসকগোষ্ঠী) কে সরিয়ে দিয়ে নিজেই প্রভু হওয়ার বাসনা — এটাই এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত মনস্তত্ত্ব।
৪.
৫ অগাস্ট ২০২৪ থেকে যা চলছে তার নাম ”বিচারহীনতা নয়, বিচার ও বিচারালয় হত্যা।”
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কোটা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। যে আন্দোলন এই নীতির পূর্ণ অবসান চেয়েছে, সে আসলে সোশ্যাল ইকুইটির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সে তার নিজের জন্য এই সুযোগ চায়। তার বিশ্বাসের বাইরের কারু জন্য তা চায় না। এটা রুজ প্রজাতির বৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে মুহাম্মাদ ইউনুসকে কেন্দ্রে রেখে পশ্চিমা শক্তি তাদের রিদম এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে। এটি মুহাম্মাদ ইউনুসের চতুর্থ জিরো এক্সপেরিমেন্ট- মারিনা আব্রামোভিচের রিদম এক্সপেরিমেন্টের কথা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন।
🔹অমর্ত্য সেন তাঁর Capability Approach-এ বলেন:
“যাঁদের সুযোগ নেই, তাদের জন্য সমান সুযোগ মানে, তাদের পরিস্থিতি বিচার করে আলাদা সুবিধা রাখা।”
অতএব, কোটা বাতিল বা স্বার্থান্ধ অবস্থান নেওয়া উন্নয়নবিরোধী ও বৈষম্য বাড়ানো নীতি থেকে কোটা আন্দোলনকারীরা সরতে বাধ্য হয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবে কি দেখা যাচ্ছে। তারা কোটা বাতিল চেয়েছে বিরোধীদের জন্য, এখন তারা কোটা আদায় করছে মব সংগঠিত করে।
মেরিনা আব্রামোভিচ দেখতে চেয়েছিলেন তার শরীর ও মনের সীমা কতোদূর। এটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না কখনোই।
৫.
গণআন্দোলনের উদ্দেশ্য হতে পারে না অগণতান্ত্রিক চাপ স্রষ্টি করে নিজের দেশ ধ্বংস করা।
অনেকে তুলনা টানেন এরশাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনের সঙ্গে। কিন্তু এটি একটি বিপজ্জনক তুলনা।
🔹এরশাদ ছিলেন স্বৈরশাসক — মিছিলে ট্রাক তুলে দেন, নির্বাচনের অধিকার কাড়েন, সংবাদপত্র বন্ধ করেন, বিরোধীদের জেলে পাঠান।
🔹বিগত সরকারের অধীনে নির্বাচন ও রাজনৈতিক অধিকার বজায় ছিল সবার, কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে পারে, কিন্তু অধিকার তার ছিল — সেখানে “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” নামে শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে পেছনে রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ও সমর্থকদের সরকার উৎখাতের ডাক রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার শামিল। তা আসলে ক্ষমতা দখলের ডাক।
গণতন্ত্র মানে “আমি চাই না তাই সরকারকে যেতে হবে” নয়। গণতন্ত্র মানে হলো — সংবিধানের সীমায় থেকে পরিবর্তন চাওয়া। কিন্তু জুলাইতে প্রথমটাই ঘটেছে। এবং মুহাম্মাদ ইউনুস নিওলিবারেল তত্ত্বের ধ্বজাধারী। তার মতো ব্যক্তিরাই এই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধু ভোগ করছেন ও করতে চাইছেন। তিনি সরাসরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এসে ক্ষমতায় বসতে পারবেন না এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন, সে কারণেই তাকে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় আসতে হলো।
জুলাইয়ের কোটা আন্দোলন কেবল একটি দাবি নিয়ে শুরু হলেও, তা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় সংবিধানবিরোধী, শ্রেণিগত বৈষম্যউত্তেজক এবং অগণতান্ত্রিক এক আন্দোলনে।
এটা তরুণ প্রজন্মের অধিকার রক্ষার চেয়ে অনেক বেশি ছিল একটি রাজনৈতিক প্রক্সি যুদ্ধ — যার নেতৃত্ব, ভাষ্য ও পরিণতি ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন, বিভ্রান্তিকর এবং রাষ্ট্রবিরোধী।