।। মনজুরুল হক।।
একটা প্রবল পরাক্রমশালী দেশের শাসকশ্রেণী যখন বিশ্বের শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন ছোট ও গরিব দেশ দখল করে তখন আমরা বলি― সাম্রাজ্যবাদী আগ্রসান, এবং সে দেশের জনগণকে শোষণ করলে যুক্তিযুক্ত কারণে সেই দায় আগ্রাসী বা দখলদার দেশের ওপর না চাপিয়ে চাপাই শাসকশ্রেণীর ওপর, কিন্তু সেই দখলদার দেশটির জনগণের ব্যাপক অংশ যদি তাদের শাসকের আগ্রাসী, হিংস্র এবং খুনি চরিত্রকে সমর্থন দেয় তাহলে নিশ্চয়ই সেই জনগণও তাদের শাসকশ্রেণীর মত সমান অপরাধী।
📍
এখানে দেখার বিষয়; আক্রমণকারী দেশটির জনগণ তাদের সরকার কর্তৃক নিপীড়িত কী-না? যেমন পাকিস্তান। পাকিস্তানী যে সেনাবাহিনী পূর্ববাংলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নৃশংসতম হলোকাস্ট ঘটিয়েছিল, সেই সেনাবাহিনী তাদের অন্যান্য প্রদেশের জনগণ সমর্থীত ছিল না। খাইবার-পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তান ও সিন্ধ প্রদেশের দরিদ্র মানুষরাও পাঞ্জাবীদের দ্বারা নিপীড়িত হতো। তাই পাঞ্জাব মেজোরিটির পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংস অপরাধ বালোচ-সিন্ধ-পাখতুন জাতির ওপর সেভাবে বর্তায় না।
📍
এদিক থেকে জার্মানী সম্পূর্ণ আলাদা। হিটলার এবং তার গেস্টাপো নাৎসি বাহিনী নিজ দেশের জনগণের ওপর নিপীড়ন চালায়নি। বিশ্ব ইতিহাসের নিকৃষ্টতম, নৃশংস হলোকাস্ট চালিয়েছে পোল্যান্ড, চেকস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, মলদোভা, ইউক্রেন, বেলারুশ, রাশিয়ার ওপর। পোল্যান্ডের আউশভিৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল শত শত ক্যাম্পের অন্যতম বিশাল হিউম্যান স্লটার হাউস! এক একটা বন্দী শিবিরে নারী-পুরষ-শিশুদের গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরানো হতো। আগুনে পোড়া মানুষের আহাজারী শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত নাৎসি সৈন্যরা।
📍
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর হাতে আনুমানিক ৬০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ ইহুদী হ/ত্যা করা হয়েছিল। অন্যান্য ধর্মের আরও কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এই সখ্যাটি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাদে। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মি ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এই সংখ্যাটি সে সময়কার সোভিয়েতের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ!
📍
মনুষ্য সভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাসে এমন আগ্রাসী, হিংস্র, নৃশংস, মানবতাবিরোধী হলোকাস্ট আগে ঘটেনি যা নাৎসি বাহিনী ঘটিয়েছিল। বিস্ময়কর হলো জার্মানীর সুশীল সমাজ এতবড় নৃশংসতার সেভাবে বিরোধীতা করেনি বা করতে পারেনি। হয়ত প্রাণভয়ে করেনি। জার্মানীকে সে যুগে বলা হতো কবি-শিল্পী-লেখক-সাহিত্যিক-নাট্যকার-সুরকার-আর্কিটেক্ট-বিজ্ঞানীদের দেশ।
📍
আরও বিস্ময়কর হলো হাজার হাজার মানবতাবাদী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে হাতে গোণা কয়েকজন মাত্র নাৎসি বর্বরতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, যাদের বেশিরভাগই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে। তাদের অন্যতম ছিল―বার্টোল্ট ব্রেখট, চার্লস বুকভস্কি, এরিখ কাস্টনার, টমাস মান, এরিখ মারিয়া রেমার্ক, ইয়াহুদা আমিচাই, মাইকেল এন্ডে, এরিক এরিকসন, অ্যান ফ্রাঙ্ক, লিয়া গোল্ডবার্গ, গেরো ভন উইলপার্ট প্রমূখ। এদের মধ্যে অ্যান ফ্রাঙ্ক নিজেই বন্দী শিবিরে থাকা অবস্থায় তার বিখ্যাত ডাইরি লিখেছিলেন। এরখি মারিয়া রেমার্ক তার বিখ্যাত উপন্যাস-‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ লিখেছিলেন নিজেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে।
📍
এ কারণে আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জার্মানীদের ঘৃণা করি। আজকে যারা আধুনিক জার্মানকে শিল্পবিপ্লব, মানবিকতা, আশ্রয়স্থল বলে লেজিটিমেসি দেন আমি তাদেরও ঘৃণা করি। আমি আমার যাপিত জীবনে সবচেয়ে বেশি দেখেছি ওয়ার মুভি। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত বিভিন্ন ভাষার মুভি, পড়েছি ইতিহাস, সাহিত্য, এবং আজও আমি সমানভাবে আৎকে উঠি! চমকে উঠি! সিনেমায় কিছু অতিরঞ্জন হয়। আবার অনেক সময় প্রকৃত ভয়াবহতা তুলে ধরা যায় না হলোকাস্টহ্যালুসিনেশন ঘটার ভয়ে।
📍
সেই নৃশংস নির্মমতার বিরুদ্ধে চুপ থাকা জার্মানীরা আজ তাদের নীরব থাকার পাপ মোচন করবার জন্য কোনও চলৎশক্তিহীন নাৎসি অপরাধীকেও ক্ষমা করে না। গত দশকেও দেখা গেছে মৃত্যুমুখে পতিত নাৎসি সদস্যদের কারাগারে পাঠিয়ে বিচার করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘বৃদ্ধ’ বলে ক্ষমা পায়নি।
📍
আর আমরা কার্যত নৃশংস বাঙালি জাতি মাত্র ৫৩ বছরে আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপরকার হলোকাস্ট ভুলে গেছি মানবতার ধাপ্পাবাজী করে। নাৎসিরা হলোকাস্ট করেছিল সাড়ে ৫ বছর ধরে। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদর, আলসামস হলোকাস্ট করেছে মাত্র ৯ মাস। তাতেই আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ২ লক্ষ মা-বোনকে ধর্ষীতা হতে হয়েছে। তার পরও আমাদের বর্তমান শাসকদের নোংরা রাজনীতির কার্যকর ‘মিত্র’ সেই যুদ্ধাপরাধীরা। তাদেরই অন্যতম স্টেকহোল্ডার আজকের তথাকথিত অভ্যুত্থানের তরুণদের মাস্টারমাইণ্ড বলছে―’৭১ এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন ও বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা সঠিক হতে পারলে ’২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান মেটিকুলাস ডিজাইন হলে সমস্যা কোথায়?’’এ না জানে ইতিহাস, না জানে শ্রেণীসংগ্রাম, না জানে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধপরবর্তী জনমানুষের ভাবাবেগ।
জার্মানীরা কি এদের চেয়েও ঘৃণা ডিজার্ভ করে?