ডাচ শিশুরা বিশ্বের সবচেয়ে সুখী। এ বছর ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওইসিডিভুক্ত ৪৩টি দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডসের শিশুরাই সবচেয়ে সুখী বলে উঠে এসেছে। কিন্তু কেন এমনটা হয়েছে? এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে মার্কিন কিশোরী মেরি ফ্রান্সিস রাস্কেল নিজের অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনে প্রকাশিত এক লেখায়।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনার কলাম্বিয়া শহরের বাসিন্দা ওই কিশোরী ছোটবেলায় ‘ফ্রি রেঞ্জ’ বা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ পেয়েছিল। গ্রীষ্মের বিকেলে বন্ধুর সঙ্গে লেকের ধারে পরিত্যক্ত একটি জায়গায় বসে স্লাশি আর ক্যান্ডি খাওয়ার মুহূর্তগুলো এখনো তার প্রিয় স্মৃতি। নিজের মতো করে আশপাশে হাঁটতে যাওয়া, বন্ধুদের বাসায় যাওয়া বা দোকানে গিয়ে সময় কাটানো—এসব ছোট ছোট স্বাধীনতাই যেন তার জন্য ছিল বড় শিক্ষা।
তবে এই অভিজ্ঞতা ছিল ব্যতিক্রমী। কারণ, তার আশপাশের বেশির ভাগ শিশুর এমন স্বাধীনতা ছিল না। বেশির ভাগ অভিভাবক পূর্বপরিকল্পনা করে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতেন, যা শিশুদের তাৎক্ষণিক আনন্দের ইচ্ছার সঙ্গে খাপ খেত না।
ডাচ অভিজ্ঞতা
মেরি ফ্রান্সিস সম্প্রতি নেদারল্যান্ডস সফরে গিয়েছিল। হারলেম শহরের এক প্রবাসী মার্কিনির বাসায় কয়েক দিন কাটিয়ে সে দেখে, ডাচ শিশুদের জীবনধারায় স্বাধীনতা বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায়। তিন সন্তানের মা সেই প্রবাসী জানান, তাঁর ছেলেমেয়েরা নিজেরাই বাইক চালিয়ে স্কুলে যায়, বন্ধুর বাসায় যায়, দোকানে যায়। কেউই সব সময় বড়দের ওপর নির্ভরশীল নয়।
এমন চিত্র শুধু এই পরিবারের নয়। নেদারল্যান্ডসে শিশুদের স্বাধীন চলাফেরা, বাইক চালিয়ে যাতায়াত, বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খেলা—সবই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকে বাইক চালানো শেখানো হয় দেশটিতে। এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে আত্মবিশ্বাস।
মজার ব্যাপার হলো, ডাচ ও যুক্তরাষ্ট্র, দুই দেশের অভিভাবকেরাই শিশুদের স্বাধীনতা দিতে চান বলে দাবি করেন। ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, পাঁচ থেকে আট বছর বয়সী শিশুদের ৭৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিশুকে নিজের কাজ নিজে করতে দেওয়া উচিত। ৯ থেকে ১১ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৮৪ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মার্কিন শিশুদের কেবল ৩৩ শতাংশ একা হাঁটতে বা বাইকে করে বন্ধুর বাসায় যেতে পারে। আর ১৫ শতাংশ শিশু হ্যালোইন উৎসবে অংশ নিতে পারে।
নিরাপত্তার ভয় নাকি অতি সতর্কতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমেরিকান অভিভাবকেরা অতিরিক্ত নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে সন্তানদের স্বাধীনতা সীমিত করে ফেলছেন। ২০২৩ সালের পিউ রিসার্চের জরিপে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ অভিভাবক সন্তানদের মানসিক সমস্যার আশঙ্কায় ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’। ৩৬ শতাংশ ‘কিছুটা উদ্বিগ্ন’। এর ফলে অনেকে নিজেরাই স্বীকার করেন, তাঁরা ‘অতি সতর্ক’।
গবেষকেরা বলছেন, স্বাধীন চলাফেরা ও নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ শিশুদের মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে যাওয়া বা স্বাধীনভাবে কিছু করার সুযোগ কমে যাওয়াতেই শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক সমস্যার হার বেড়েছে। এই গবেষণায় ‘ইন্টার্নাল লোকাস অব কন্ট্রোল’ ধারণার কথা বলা হয়েছে। এর মানে হলো, একজন ব্যক্তি নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার অনুভূতি পায়। শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে না শেখে, তাহলে বড় হয়ে তারা নিজের সমস্যা সমাধানে অক্ষম হয়ে পড়ে, যা মানসিক উদ্বেগ বা বিষণ্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিশোরী লেখিকা জানিয়েছে, সে কাউকে সন্তান পালনে নির্দেশ দিতে চায় না। কিন্তু সদ্য স্কুল শেষ করা একজন হিসেবে সে জানে, ছোটবেলার সেই স্বাধীনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই সে অভিভাবকদের প্রতি ছোট পরামর্শ দিয়েছে। বলেছে, ‘এই গ্রীষ্মে আপনার সন্তানকে একা পার্কে যেতে দিন, একা আইসক্রিম কিনতে দিন কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে নিজের মতো করে সময় কাটাতে দিন। এই ছোট ছোট স্বাধীনতাই হয়তো বড় হয়ে গিয়ে রূপ নেবে আত্মবিশ্বাসী, সুখী ও মানসিকভাবে সুস্থ একজন মানুষের’। সূত্র: সিএনএন