মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এক দীর্ঘ ও বর্ণময় অধ্যায়ের সাক্ষী মাহাথির মোহাম্মদ। গতকাল ১০ জুলাই ১০০ বছর পূর্ণ করলেন তিনি। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল এবং ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই দফায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ আজও দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। রোনাল্ড রিগান, মার্গারেট থ্যাচার, লি কুয়ান ইউ এবং দেং জিয়াওপিংয়ের মতো বিশ্বনেতাদের সমসাময়িক মাহাথির, তাঁদের মতোই স্বতন্ত্র নীতি এবং অর্থনৈতিক রূপান্তরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
অর্থনৈতিক সাফল্যের কারিগর
গত ৪৪ বছরের মধ্যে ২৪ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবিদার। ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়া মূলত পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রাবার ও টিন শিল্পের নিয়ন্ত্রণ করত। পরে পেট্রোলিয়াম, কাঠ ও পাম তেল রপ্তানি নির্ভর হয়ে পড়ে মালয়েশিয়া। বর্তমানে এ দেশ একটি বৈচিত্র্যময় উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ইলেকট্রনিকস এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য।
যদিও মাহাথির প্রায়শই বহির্বিশ্বের প্রতি সমালোচকমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেছিলেন, তবুও তিনি বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি মালয়েশিয়ার বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে দ্রুত একত্রীকরণ এবং আকর্ষণীয় অবকাঠামো নির্মাণ তত্ত্বাবধান করেন। তাঁর শাসনামলে ১৯৮০ সালে মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ১ হাজার ৯০০ মার্কিন ডলার থেকে গত বছর প্রায় ১২ হাজার ৫০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
১৯৯৭-৯৮ সালের এশীয় আর্থিক সংকটে মাহাথিরের অপ্রচলিত পদক্ষেপ ও কৌশল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিশ্বব্যাপী সাধুবাদ পায়। এই উদ্যোগ তাঁর খ্যাতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওই সময় মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত তলানিতে নেমে গিয়েছিল এবং অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এরপরও মাহাথির আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ সহায়তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি পুঁজির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন এবং মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। মালয়েশিয়ার অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়।
বিতর্কিত রাজনৈতিক উত্তরাধিকার
মাহাথিরের অর্থনৈতিক সাফল্য এবং সাধারণ মানুষের নেতা হিসেবে ভাবমূর্তি তাঁর দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তার কারণ। ২০১৮ সালে প্রাক্তন ডেপুটি এবং পরবর্তীতে প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর আরেক সাগরেদ নাজিব রাজাককে ক্ষমতাচ্যুত করেন। দীর্ঘদিন পর এভাবে রাজনীতির ময়দানে তাঁর অসাধারণ প্রত্যাবর্তন ঘটে।
তবে, রাজনৈতিকভাবে মাহাথির মূলত একটি বিতর্কিত উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। মালয়েশিয়ার সমাজে সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয়গুলো—জাতি এবং ধর্ম—তাঁকে বারবার প্রভাবিত করেছে। মালয়েশিয়ায় এই ধারণাগুলো অবিচ্ছেদ্য, কারণ সংবিধান অনুযায়ী একজন মালয়কে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে—এমন ধারণার ওপর জোর দেওয়া হয়।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় মাহাথিরের বিতর্কিত বই ‘দ্য মালয় ডিলেমা’। দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা মেনে নেওয়ার জন্য তিনি মালয়দের তিরস্কার করেন। যেখানে ওই সময় যারা তখন মালয়রা ছিলেন জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। তিনি যুক্তি দেন, কৃষি ও মৎস্য চাষ হলো অলস বিকল্প। এটিই মালয় সম্প্রদায়ের উন্নতির পথে মূল বাধা ছিল। তিনি মালয়দের চীনা এবং ভারতীয় সংখ্যালঘুদের (তখন যথাক্রমে জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ) ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ সংক্রান্ত নীতিগুলোকে সমর্থন করেছিলেন। অথচ তাদেরকেই মাহাথির তাঁর কর্মজীবন জুড়ে মালয়েশিয়ার প্রতি আনুগত্যহীনতার জন্য তিরস্কার করেছেন।
১৯৮০ সালে জাতিগত-চীনা সংখ্যালঘু ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করে। ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ভারসাম্যহীনতা দূর করার চেষ্টা, পছন্দের মালয় ব্যবসায়ীদের জন্য প্রচুর সরকারি তহবিল বরাদ্দ, তাঁর ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি লালন করার অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগ মাহাথিরের পদত্যাগের পরেও দীর্ঘকাল ধরে টিকে ছিল। এর চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ২০১৫ সালে উন্মোচিত ওয়ান এমডিবি কেলেঙ্কারি। সরকারের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা একটি সার্বভৌম সম্পদ তহবিল থেকে বিলিয়ন ডলার চুরি করেছিল। নাজিব রাজাক এই দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
মাহাথিরকে কিছু প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিকে দুর্বল করার জন্যও দায়ী করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রগুলো আরও ভালো তদারকি এবং জবাবদিহি দাবি করে। তিনি চাইলে সেটি করতে পারতেন। এর মধ্যে তিনি নিজেও ছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে মাহাথির বিচার বিভাগ; দেশের নয়টি রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী বংশানুক্রমিক মালয় শাসক; এবং তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে ধারাবাহিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। ব্রিটিশদের উপনিবেশের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে ১৯৮৭ সালে ১০০ জনেরও বেশি রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, কর্মী এবং অন্যদের গ্রেপ্তার করেন মাহাথির। একটি শক্তিশালী নির্বাহী শাখার দিকে তিনি বেশি জোর দিয়েছে, যেখানে জবাবদিহির ব্যবস্থা ছিল দুর্বল।
বর্তমান প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
২০১৮ সালে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হন মাহাথির। এর ফলে ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) প্রথম নির্বাচনী পরাজয়ের মুখে পড়ে। অথচ এই দলটিকে মালয় রাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি নিজেই অনেক কিছু করেছিলেন। এরপর মাহাথিরের জোট খুব স্বল্পস্থায়ী ছিল। তিনি ২০২০ সালে ক্ষমতা হারান এবং দুই বছর পর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হন।
রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলেন, মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশীয় সমাজে তাঁর বিভাজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভিযোগ খণ্ডন করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে আরেকটি প্রত্যাবর্তনের জন্য সম্ভবত খুব দেরি করে ফেলেছিলেন। অনেক সমালোচক বলেন, তিনি মালয়েশিয়াকে একটি শিথিল বহু সংস্কৃতির সমাজে পরিণত হওয়ার পথে একটি বাধা হয়ে রয়ে গেছেন। এই অগ্রগতিতে বাধা হওয়াটাই সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার হিসেবে রয়ে যাবে!