কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের বহুল প্রশংসিত বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগী ৪ হাজার ৪০৯ জন জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ও হতদরিদ্রদের তালিকা বাতিল করেছে ইউনূস সরকার।
‘ত্রুটিপূর্ণ, প্রশ্নবিদ্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট’—এই অভিযোগে তালিকাটি বাতিল করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হলেও বিশ্লেষকদের মতে, এটি মূলত প্রতিহিংসাবশত নেওয়া একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই অসহায় পরিবারগুলো, যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। তারা সরকারের এমন সিদ্ধান্তে চোখে অন্ধকার দেখছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ২০১৭ সালে কক্সবাজার শহরের নিকট খুরুশকুল এলাকায় শুরু হয় জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের এই প্রকল্প। ২৫৩ একর জমিতে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহহীনদের জন্য গড়ে তোলা হয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বহুতল ভবন। পুনর্বাসন জোনে ১১২ একর জমিতে নির্মিত হচ্ছে ১২৯টি পাঁচতলা ভবন, প্রতিটিতে ৩২টি করে ফ্ল্যাট। পানি, বিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, গ্যাস সিলিন্ডার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার স্টেশন—সবই রয়েছে এই পরিকল্পনায়।
১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের পাশে খাসজমিতে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর জন্য এই প্রকল্প ছিল আশার আলো। শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ১৯শে মে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী এলাকায় গিয়ে পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে ধারাবাহিকতায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ইতোমধ্যে প্রায় ৩ লাখ ১৯ হাজার পরিবার ঘর পেয়েছে। এই বিশেষ প্রকল্পে ২০২০ সালের ২৩শে জুলাই প্রথম পর্যায়ে ৬০০ পরিবারকে নামমাত্র ১০০১ টাকায় ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হয়।
চলতি বছর ১৪ই মার্চ কক্সবাজার সফরে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে খুরুশকুল প্রকল্প পরিদর্শনের পর থেকেই এই প্রকল্পকে ঘিরে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় প্রজ্ঞাপন জারি করে উপকারভোগী তালিকা বাতিল করা হয়েছে ১৪ই জুলাই সোমবার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, উন্নয়নশীল দেশের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা এ ধরনের জনবান্ধব প্রকল্প রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। শেখ হাসিনা সরকারের নেয়া সামাজিক সুরক্ষা ও পুনর্বাসনমুখী বহু কার্যক্রম এখনো মানুষ সুফলভোগ করছে। কিন্তু এই প্রকল্প বাতিলের মধ্য দিয়ে ইউনূস সরকার গৃহহীন ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের ভাগ্যকে আরো অনিশ্চিত করে তুলছে।
পড়ুন: শেরপুরে আশ্রয়ণের ঘর থেকে হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ যুবদল নেতার (ভিডিও)
এই সিদ্ধান্তে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটি শুধু একটি প্রকল্প বাতিলই নয়, এটি দেশের সামাজিক ন্যায্যতার বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত। রাষ্ট্র মানবিকতা ও কল্যাণনীতি বিসর্জন দিয়ে, অসহায় মানুষের বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু কেড়ে নিয়েছে।
এদিকে রাজনীতি সচেতন স্থানীয় প্রবীণরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলো গৃহহীন মানুষের আশার আলো দেখিয়েছিল। বাস্তুসংস্থান হয়েছে লাখো অসহায় মানুষের। ঘর ও জমির মালিক হয়েছিল হতদরিদ্র মানুষজন। কিন্তু এখন লাখো মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা।
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে “আশ্রয়ণ প্রকল্প” গ্রহণ করে বিভিন্ন সময়ে। এই সুবিধা ভোগ করে দলমত নির্বিশেষে অসহায় হতদরিদ্র মানুষ। ভূমিহীন হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী পেয়েছিল বেঁচে থাকার প্রেরণা।
১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার উদ্যোগে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে সমাজচ্যুত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, দুস্থ, প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্তাসহ সমাজের অবহেলিত ও অসহায় মানুষকে পুনর্বাসন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৪ লক্ষের বেশি মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছিল। “ঘর আছে, ঘর নেই”—এই বিভেদ ঘোচানোর লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-১, আশ্রয়ণ-২ ও সর্বশেষ “মুজিব শতবর্ষে গৃহ প্রদান” কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের প্রায় ৫ লাখের বেশি পরিবারকে আধাপাকা ঘর প্রদান করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে রয়েছে দুই কক্ষ, রান্নাঘর, শৌচাগার ও বিদ্যুৎ সুবিধা। এসব কাজ হাসি ফুটিয়েছে অসহায় মানুষদের মুখে।
এই প্রকল্প শুধু বসবাস নয়, বরং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকেও নজর দিয়েছে। ঘরপ্রাপ্ত পরিবারগুলো পেয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ, কৃষি সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও ঋণ। আওয়ামী লীগ সরকারের এসব মানবিক কাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূল, হাওর, চরাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনধারায় এনেছে আমূল পরিবর্তন। শেখ হাসিনার “কেউ গৃহহীন থাকবে না” অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এই প্রকল্প আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছে।
অথচ গত বছরের ৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোর ওপর চালানো হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয়ণের ঘরগুলো থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে সুবিধাভোগীদের, অনেক জায়গায় আশ্রয়ণের ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়ি ভেঙে জমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় গৃহবাসীদের থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হচ্ছে, কোথাও কোথাও আশ্রিতদের বের করে দিয়ে উল্টো সেসব ঘর ভাড়া দেওয়ার সংবাদও মিলেছে।
আর এবার খোদ ড. ইউনূস আওয়ামী লীগ সরকারের মানবিক এই মহৎ প্রকল্প বাতিল করে দিলেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও দারিদ্র দূরীকরণের ফর্মূলাদাতা ড. ইউনূসের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে অবিলম্বে প্রকল্পটি বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন সুধীজন।