।। আদনান মনোয়ার হুসাইন।।
ঢাকা শহরে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সুস্থির হওয়ার জন্য ছটফটও করতে হয়। বদ্ধ ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয়, চার দেয়ালে নিঃশ্বাস আটকা পড়ে বিষাক্ত হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে। এ সময় মনে হতেই পারে, একটু নির্জনে কোথাও নিরিবিলি বসি। নিজেরও অনেক সময় মনে হতো, যদি গৌতম বুদ্ধের মতো সব ছেড়েছুড়ে নির্জনে কোনো গাছের নিচে আপন মনে নিমগ্ন হতে পারতাম! ঢাকায় অনেক স্থান আছে বটে, কিন্তু তেমন পরিবেশ নেই।
দুই.
বাসার কাছেই আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকা। সুবিন্যস্ত মস্ত এলাকা, সুপ্রশস্ত সড়ক, প্রচুর গাছগাছালি, অনেক ফাঁকা জায়গা। মনে হলো, এমন একটা জায়গাই খুঁজছি আমি। একদিন রাত কিছু ঘনালে চলে গেলাম। সড়কবাতির আলোয় চওড়া ডিভাইডারে রাধাচূড়াগুলো ঝলমল করছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে নির্বাচন কমিশন হয়ে পিএসসি পর্যন্ত সড়কের দু’পাশজুড়ে মেলার মতো অস্থায়ী দোকানপাট; ফুচকা-চটপটিই বেশি। প্রচুর মানুষ– পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব মিলে সময় কাটাচ্ছে। সময় কাটানোর মতো চমৎকার জায়গা। কিন্তু আপনমনে বসে থাকা গেল না। বাইক আর গাড়ির তীব্র শব্দ, কানে তালা লাগানো হর্ন অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলল। হাতিরঝিলেও কি একাকী বসা যায়? জলাধারঘেঁষা গাছগাছালি ছাওয়া ওয়াকওয়ের কোথাও উজ্জ্বল আলো, কোথাও অন্ধকার। বেঞ্চে বসে অনেকে আড্ডা দেয়। কিন্তু আলো-আঁধারিতে কিছু মানুষ এমনভাবে ঘোরাঘুরি করে, তাদের আশপাশে একা বসা সহজ নয়। যানবাহনের এমনই শব্দ, নিজের ভাবনায় ডুবে থাকা দুষ্কর।
তিন.
৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা শহরে সোয়া ২ কোটির বেশি মানুষের বাস। তাদের মানসিক প্রশান্তির জন্য পার্ক, উদ্যান আছে কয়টা? প্রতিদিন যানজট, উচ্চ শব্দদূষণ, বাসে-ফুটপাতে অহেতুক খ্যাচখেচানি তথা রাস্তার ‘পাড়াপাড়ি’ পেরিয়ে যে মানুষ বাসায় ফেরে, তার তো কোনোদিন মনে হতে পারে, বিকেলে বা সন্ধ্যার পর বাইরে খোলা বাতাসে কোথাও একাকী কিছু সময় বসবে।
অফিস থেকে বেরিয়ে কোনোদিন তো তার মনে হতে পারে– গেলাম না বাসায়! সারারাত রাস্তায় হেঁটে বেড়াব; পার্ক বা নদীর ধারের কোনো বেঞ্চে বসে গান শুনব। এমনটা কল্পনা করাও কি সম্ভব? একটু রাত হলেই পুলিশের জেরায় জেরবার হবেন। অথচ নির্বিঘ্নে চুরি-ছিনতাই হচ্ছে।
চার.
মানসিক প্রশান্তি যে একটা পরিচর্যাযোগ্য সম্পদ, সেটা ‘অস্বীকার’ করে চলার ফলই দেখা যাচ্ছে এখন। একেকটি হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা আগেরগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মিটফোর্ডের সামনে দিনের বেলায় প্রকাশ্য রাস্তায় ব্যবসায়ীকে ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে লাশের ওপর লাফানো কি শুধুই খুনখারাবি? চুরির অপবাদ দিয়ে কারখানায় শ্রমিককে তারই সহকর্মীরা রাতভর পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলে কীভাবে! গ্রামবাসী কীভাবে বাড়িতে হামলা চালিয়ে মা এবং তাঁর ছেলেমেয়েকে পিটিয়ে মেরে ফেলে?
মধ্যযুগীয় এসব নৃশংসতার পেছনে কি কোনো মানসিক বৈকল্য নেই? শুধু হত্যায় আশ মেটে না। পৈশাচিক নৃশংসতা চালিয়ে কোন ক্ষোভ, কোন যন্ত্রণার প্রশমন চায় মন? এ চিত্র সন্ত্রাস বা রাজনৈতিক হানাহানি থেকে ভিন্ন। মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব নৃশংসতা দেখে; ভিডিও করে ফেসবুকে ছড়ায়। অন্যরা অবসর সময়ে তা বসে বসে দেখে। কেউ নৃশংসতা চালিয়ে আর কেউ সেটা দেখে অবচেতনে তৃপ্ত হচ্ছে। মর্ষকামিতা আর ধর্ষকামিতা যেন আমাদের মধ্যে হাত ধরাধরি করে চলছে।
মনোবিদরা বলেন, মানুষ যখন কোনো কিছু নিয়ে ক্রমাগত চাপে থাকে তখন তার সুস্থিরতা হারায়; বৈকল্য দেখা দেয়। সে সময় তার মানসিক প্রশান্তির ব্যবস্থা করতে হয়। সে জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেকে সময় দেওয়া। কিছুটা সময় বের করে নিজের তাড়নাগুলো নিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলা। খেই হারানো মানুষটি যেন নিজেকে শান্ত করতে পারে, তাঁকে সে রকম পরিবেশ দেওয়া। গোটা সমাজে বৈকল্য ছড়ালে তার সমাধান ব্যক্তি উদ্যোগে হয় না।
দেড়-দুই দশক ধরে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটছে। কিন্তু এর চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষ স্ট্যাটাস পাল্টানোর চেষ্টায় খাবি খেয়ে যাচ্ছে। হাপিত্যেশ নিয়ে অন্যদের উঠে যাওয়া দেখতে দেখতে তাদের মানসিক অবস্থারই ক্রমাবনতি হচ্ছে কেবল। কি গ্রাম, কি শহর– মানুষ এখন শুধুই ছুটছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়া বৈষম্য, অন্যায়-অবিচার, অনিয়ম-দুর্নীতি তাকে প্রতিনিয়ত ক্ষুব্ধ করে তুলছে। মানসিক শান্তিহীন মানুষ যে কোনো কিছু করতে পারে।
আর্থিক উন্নয়নের কালে সমাজে যে নৈরাজ্য দেখা দেয়, তার বড় অংশই আসে নাগরিকের নৈরাশ্য থেকে। তখন জরুরি হয় সুশাসন এবং নীতি-নৈতিকতার চর্চা।
আদনান মনোয়ার হুসাইন: সহকারী বার্তা সম্পাদক, সমকাল