।। ইজাজ মামুন।।
আগস্ট ২০২৪ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গভীর সংকট শুরু হয় — যা কেবল শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক স্বাধীনতাই নয়, বরং জাতির সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ফেলে। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জাতীয় স্মৃতি মুছে ফেলা, সাংস্কৃতিক প্রতীক ভেঙে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনর্লিখন, ও জাতিসত্তার প্রকাশকে দমন করার ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ইউনূসপন্থী গোষ্ঠী—বিশেষ করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’, ‘তৌহিদি জনতা’ ও ‘জামায়াতে ইসলামী’—মুখ্য ভূমিকা রাখছে।
মানবাধিকার কর্মী ও গবেষকেরা এই পরিস্থিতিকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন—যার মাধ্যমে একটি জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও ভাষাগত পরিচয় পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। যদিও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এখনও এটি ‘শারীরিক গণহত্যা’র মতো স্বীকৃতি পায়নি, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো উইঘুর নিপীড়ন (চীন) কিংবা গাজায় সাংস্কৃতিক নিধনের প্রেক্ষাপটে এ শব্দটি ব্যবহার করেছে।
প্রতিশ্রুতি থেকে নিপীড়নের পথে
২০২৪ সালের আগস্টে মুহাম্মদ ইউনূস যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন বহু মানুষ শান্তি, সংস্কার ও জাতীয় ঐক্যের আশা করেছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যে তার সরকার নানা অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে—সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, মতাদর্শিক সহিংসতা, ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধ্বংস করার মত গুরুতর অপরাধের জন্য।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হলেও দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে উঠেছে একটি বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, যার মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ও অন্তর্ভুক্ত। ইউনূস সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম আলো-এর খবরে প্রকাশ, ২০২৪ সালের ৫ থেকে ২০শে আগস্ট পর্যন্ত ৬৪টি জেলা ও ৬৭টি উপজেলায় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ১,০৬৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই সময়কালে মোট ২,০১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত হয়, যার ফলে ১,৭০৫টি পরিবার প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১৫৭টি পরিবার বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের শিকার হয়। কিছু পরিবার জমি দখলের মুখে পড়ে এবং ৯ জনের মৃত্যু ঘটে।
উল্লেখযোগ্য হামলার মধ্যে রয়েছে খুলনায় রাধা-গোবিন্দ মন্দির এবং সিলেটে ইসকন প্রাঙ্গণে আগুন দেওয়া। চট্টগ্রামের ইসকনের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে সহিংসতার প্রতিবাদ করায় “সাম্প্রদায়িক উসকানির” অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। আবারও হামলা হয় রামু বৌদ্ধ বিহারে, যদিও সরকার পূর্বে বৌদ্ধ ঐতিহ্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বরিশাল ও নেত্রকোনার গির্জায় পেট্রোল বোমা হামলা চালানো হয় তথাকথিত রাজনৈতিক বিক্ষোভের সময়। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে সেনা-সমর্থিত জমি অধিগ্রহণের ফলে চাকমা ও মারমা আদিবাসী পরিবারগুলো বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের সংস্কৃতি হারানোর মুখে পড়েছে।
ইতিহাস, মন্দির এবং পাঠ্যবই—সব কিছুই লক্ষ্যবস্তু
২০২৪ সালের শেষভাগে বেশ কিছু প্রতিবাদে দেশের বহু মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা হয়, অথচ পুলিশ নির্বিকার থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী কর্মীরা অভিযোগ করেন, বিদ্যালয়গুলো থেকে চাকমা ভাষার সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
২০২৫ সালের একুশে বইমেলায় মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, জাতির জনক, ধর্মনিরপেক্ষতা ও “ইসলামবিরোধী” বলে বিবেচিত বহু বই নিষিদ্ধ করা হয়। এই প্রবণতা একটি একনায়কতান্ত্রিক সংস্কৃতি-একরূপীকরণের ইঙ্গিত দেয়—যা বাঙালি জাতির বহুমাত্রিক ঐতিহ্যকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে।
৩২ নম্বর বাড়ি: প্রতীকী ধ্বংস
ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি কেবল একটি ভবন নয়; এটি ছিল জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এখানেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ও অন্যান্য উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরা এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে আগুন দেয়। ঘটনার আগের রাতে সামাজিক মাধ্যমে বলা হয়, “আজ রাতেই বাংলাদেশ মুক্ত হবে ফ্যাসিবাদের পুণ্যভূমি থেকে।”
স্লোগান ওঠে: “সোনার বাংলা নয়, খিলাফত চাই।” ভবনে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করা হয়, দাঙ্গাকারীরা দমকল বাহিনীকে বাধা দেয়, পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে—উর্ধ্বতন নির্দেশে “নিরব পর্যবেক্ষণের” অবস্থান নেয়। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি বুলডোজার দিয়ে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, এটি “রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভাজক প্রতীক”—যা আশ্চর্যজনকভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের ব্যবহার করা ভাষার সঙ্গে মিলে যায়।
এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়; বরং একটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস, যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী পরিচয় মুছে ফেলা।
স্মৃতি নির্মূলের আদর্শিক যুদ্ধ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এখন আর স্কুলের পাঠ্যবইয়ে নেই। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ অডিও আর্কাইভ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তার প্রতিকৃতি সরকারি দপ্তরগুলো থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। এখনকার সরকারি অর্থায়নে নির্মিত ডকুমেন্টারিতে “বানোয়াট ইতিহাস” উপস্থাপন করা হচ্ছে—যেখানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, আর আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ শিকড়কে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনার দাবিও কূটনৈতিক আলোচনার এজেন্ডা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
জাতির পিতার নেতৃত্ব নিয়ে প্রকাশিত বইগুলো পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় আর্কাইভও “নিরাপত্তা যাচাইয়ের” অজুহাতে ১৯৭১ সালের প্রাথমিক দলিলপত্রে প্রবেশ সীমিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর নিষেধাজ্ঞা
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যক্রম “রাজনৈতিক অপব্যবহারের” অভিযোগে বন্ধ রাখা হয়েছে। ঢাকা ও অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বাজেট কাটছাঁট করা হয়েছে এবং সরকারি হস্তক্ষেপে প্রদর্শনী সরিয়ে ফেলা হয়েছে বা তথাকথিত “ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা”র নামে পুনঃপর্যালোচনা করা হয়েছে।
জয়নুল আবেদিনের শিল্পকলা জাদুঘর, লালনের আখড়া, মহাস্থানগড়ের প্রত্নস্থল—সবই অবহেলায় পড়ে আছে। ২০২৫ সালের শুরুতে শহিদ মিনার ঘিরে আয়োজিত ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান “নিরাপত্তার কারণে” সীমিত করা হয়।
সংস্কৃতি, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে দমন
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধপন্থী নাগরিক সমাজ ও গবেষণা কার্যক্রমের ওপরও নজরদারি শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন।
বলা হচ্ছে, বাংলা একাডেমি এখন ‘শাসকগোষ্ঠীঘনিষ্ঠ’ আমলাদের দ্বারা পরিচালিত, যার ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুফিয়া কামাল ও শামসুর রাহমানকে ঘিরে আয়োজিত অনেক অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি রাজনৈতিক কারণে ৭০টিরও বেশি নাট্যপ্রদর্শনী বাতিল করেছে—যার মধ্যে ছিল ১৯৭১, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্য নিয়ে নাটক।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার অভাব
২০২৫ সালের গ্লোবাল পিস ইনডেক্স অনুসারে, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণতার দিক থেকে ১২৩তম অবস্থানে নেমে এসেছে—গত এক দশকে সবচেয়ে খারাপ। প্রতিবেদনে বলা হয়, “পুরো অঞ্চলে ও ২০২৫ সালের সূচকে সবচেয়ে বেশি শান্তির অবনতি বাংলাদেশে ঘটেছে।” জীবনযাত্রার ব্যয়, সরকারের নিষ্ক্রিয়তা, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা—সবকিছু মিলে বিক্ষোভের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
অথচ এত বিশাল নিপীড়নের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ। জাতিসংঘ এখনো সাংস্কৃতিক গণহত্যা নিয়ে তদন্ত শুরু করেনি। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স চুপ করে আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো “গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রকল্পে” অর্থ দিচ্ছে। হিন্দুদের ওপর প্রত্যক্ষ হামলার পরও ভারতের নিরবতা নানা ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন তোলে।
পরিচিতি: ইজাজ মামুন একজন ফ্রিল্যান্স লেখক