যদি আপনাকে বলা হয় যে কঠোর পরিশ্রম ছাড়াই মাত্র দুই বছরে শূন্য থেকে মিলিয়নিয়ার হওয়া সম্ভব, আপনি কি বিশ্বাস করবেন? বেশিরভাগ মানুষই করবে না, কারণ আমরা মনে করি সাফল্য মানেই রক্ত-জল করা খাটুনি। কিন্তু মানি এক্সপার্ট কোডি স্যানচেজ বলছেন, এটা একটা বিরাট ভুল ধারণা। আসল খেলাটা পরিশ্রমের নয়, বরং বুদ্ধিমত্তার সাথে সঠিক সুযোগ খুঁজে বের করার।
The Diary of a CEO পডকাস্টে কোডি স্যানচেজ তার ওয়াল স্ট্রিটের ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এমন কিছু অপ্রচলিত এবং কৌশল শেয়ার করেছেন, যা আমাদের টাকা, ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে ভেঙে দেবে। তার মতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দরজা সবার জন্যই খোলা, শুধু সঠিক চাবিটা জানতে হবে।
কোডি স্যানচেজের মতে, আমরা ধীরে ধীরে মালিকের জাতি থেকে ভাড়াটিয়ার জাতিতে পরিণত হচ্ছি। আমরা অন্যের অধীনে চাকরি করি, অন্যের স্বপ্ন পূরণ করি এবং অন্যের তৈরি করা নিয়মে জীবন কাটাই। তার জীবনের মূল মিশন হলো মানুষকে এই ভাড়াটিয়ার মানসিকতা থেকে বের করে এনে মালিকের আসনে বসানো, যাতে তারা নিজেদের জীবনের স্থপতি হতে পারে।
কেন আপনার প্রিয়জনেরাই আপনার সবচেয়ে বড় বাধা?
এটি একটি কঠিন সত্য, কিন্তু কোডি বলেন, যারা আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তারাই প্রায়শই আপনার স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা আপনার জন্য সেরাটা চায় না, তারা চায় আপনি নিরাপদ থাকুন। ঝুঁকিহীন জীবন মানেই হলো বৃদ্ধিহীন জীবন। তাই, বড় স্বপ্ন দেখতে হলে আপনাকে প্রিয়জনদের দেওয়া নিরাপত্তার গণ্ডি ভাঙার সাহস রাখতে হবে।
কোডি যখন তার কর্পোরেট চাকরিতে আটকা পড়েছিলেন, তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেননি। তাই তিনি চাকরির পাশাপাশি ছোট ছোট বোরিং বিজনেস (যেমন: লন্ড্রোম্যাট) কেনা শুরু করেন। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটি আয়ের উৎস তৈরি করা যা তার অনুপস্থিতিতেও চলতে থাকবে। এই ছোট পদক্ষেপই তাকে বড় অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
কীভাবে আপনার প্রথম ব্যবসা কিনবেন?
আপনার দক্ষতা ব্যবহার করুন: আপনি যে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন, সেই ইন্ডাস্ট্রির কোনো ছোট ব্যবসা কেনার চেষ্টা করুন। যেমন, আপনি যদি কনটেন্ট তৈরি করেন, তাহলে একটি ছোট প্রোডাকশন স্টুডিও কেনার কথা ভাবতে পারেন। এতে আপনার শেখার পথ অনেক ছোট হয়ে যাবে।
উদ্দেশ্য খুঁজুন: ব্যবসার মালিকের সাথে কথা বলুন। তিনি কেন ব্যবসাটি বিক্রি করতে চান? বেশিরভাগ সময় মালিকরা অবসরে যেতে চান বা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আপনি তাদের সেই মুক্তির পথ হতে পারেন।
টাকা ছাড়াও ব্যবসা কেনা সম্ভব
এটিই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্যবসা কেনার জন্য আপনার নিজের টাকার প্রয়োজন নেই। বেশিরভাগ ছোট ব্যবসার মালিকরা তাদের ব্যবসার জন্য নগদ ক্রেতা খুঁজে পান না। আপনি তাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ লাভের একটি অংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় শূন্য ডাউন পেমেন্টে ব্যবসাটি কিনতে পারেন। অর্থাৎ, ব্যবসার টাকা দিয়েই ব্যবসাকে কেনা।
কেন বেশিরভাগ মানুষ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায় না?
এর মূল কারণ মনস্তাত্ত্বিক। ছোটবেলা থেকে টাকা নিয়ে আমাদের মনে এমন সব নেতিবাচক ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় (যেমন: টাকা সব নষ্টের গোড়া), যার ফলে আমরা অবচেতনভাবেই টাকাকে ভয় পাই। কোডি একটি ওয়ার্কশপের উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেখানে সফল নারীদেরও টাকা নিয়ে কথা বলার সময় লজ্জায়, ভয়ে সংকুচিত হয়ে যেতে দেখা গেছে। এই মানসিক বাধা দূর করতে না পারলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন প্রায় অসম্ভব।
কীভাবে প্রথম পদক্ষেপ নেবেন?
ব্রেক দ্য ফ্রেম: আপনার যদি ৩ বছরের কোনো লক্ষ্য থাকে, নিজেকে প্রশ্ন করুন, কীভাবে আমি এটা ৬ মাসে অর্জন করতে পারি? এই প্রশ্নটি আপনাকে গতানুগতিক চিন্তার বাইরে বের করে আনবে এবং অসাধারণ সব আইডিয়ার জন্ম দেবে।
কীভাবে নয়, কে: আপনার প্রশ্ন হওয়া উচিত নয়, আমি কীভাবে এটা করব? বরং প্রশ্ন করুন, কে আমাকে এটা করতে সাহায্য করতে পারে? সঠিক মানুষ খুঁজে বের করাই সাফল্যের দ্রুততম পথ।
কোডি বলেন, সফলতার জগতে একটি অদৃশ্য পর্দা আছে, যার আড়ালের খবর সাধারণ মানুষ পায় না। তিনি যখন ফিন্যান্সে কাজ করতেন, তখন দেখেছিলেন যে বিলিয়নিয়াররা কঠোর পরিশ্রমের চেয়ে মানি গেমস বা টাকার খেলা খেলেই বেশি সম্পদ তৈরি করছেন।
কীভাবে পর্দার আড়ালে যাবেন? আপনার চেয়ে সফল কোনো ব্যক্তির সাথে কাজ করুন, এমনকি বিনামূল্যে হলেও। তাদের সান্নিধ্যে থেকে আপনি এমন সব কৌশল শিখবেন যা কোনো বই বা কোর্সে পাওয়া সম্ভব নয়।
সফল ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য
দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা: তারা তাৎক্ষণিক লাভের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
বড় মিশন: তাদের জীবনের লক্ষ্য এতটাই বড় হয় যে, পথের ছোট ছোট যন্ত্রণা বা ব্যর্থতা তাদের আটকাতে পারে না।
সাহায্যের মানসিকতা: তারা যখন দেখে যে কেউ সত্যিই ক্ষুধার্ত এবং কঠোর পরিশ্রমী, তখন তারা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।
কনটেন্ট তৈরি কেন আপনার জন্য জরুরি?
চুম্বকের মতো আকর্ষণ: কনটেন্ট আপনাকে মানুষের কাছে গিয়ে নিজেকে বিক্রি করতে বাধ্য করে না, বরং সঠিক মানুষকে আপনার দিকে টেনে আনে। এটিই হলো পুশ মার্কেটিং বনাম পুল মার্কেটিং-এর পার্থক্য।
নেটওয়ার্কিং-এর সেরা উপায়: কনটেন্ট হলো আধুনিক যুগের নেটওয়ার্কিং। এর মাধ্যমে আপনি আপনার কমিউনিটি খুঁজে পান, যারা আপনার মতো করেই ভাবে এবং আপনাকে সমর্থন করে।
সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি বেদনাদায়ক কিন্তু জরুরি অংশ হলো পুরনো বন্ধু বা পুরনো পরিচয়কে পেছনে ফেলে আসা। যখন আপনি দ্রুতগতিতে এগোতে থাকবেন, তখন আপনার চারপাশের অনেকেই আপনাকে টেনে ধরতে চাইবে, কারণ আপনার সাফল্য তাদের নিজেদের ব্যর্থতাকে মনে করিয়ে দেয়।
কীভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন?
ডেডলাইন দিন: একদিন করব বা এক বছর পর করব – এই ধরনের অস্পষ্ট লক্ষ্যের কোনো মূল্য নেই। আপনার ক্যালেন্ডারে একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করুন। একটি ডেডলাইন আপনার মস্তিষ্ককে কাজ করতে বাধ্য করবে।
স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য: ৫ বা ১০ বছরের পরিকল্পনা না করে, ৩-৬ মাসের ছোট ছোট লক্ষ্যের উপর মনোযোগ দিন। জীবন পরিবর্তনশীল এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বেশিরভাগ সময়ই অকেজো হয়ে পড়ে।
টাকা নিয়ে আপনার দর্শন কী হওয়া উচিত?
জমানো নয়, আয় করা: আপনি টাকা জমিয়ে কখনো ধনী হতে পারবেন না, আপনাকে আয় করে ধনী হতে হবে।
কফি কেনা বন্ধ করবেন না: ছোট ছোট খরচ বাঁচিয়ে বড়লোক হওয়ার ধারণাটি একটি মরীচিকা। বরং কীভাবে নিজের আয় বাড়ানো যায়, সেদিকে মনোযোগ দিন।
টাকার ভাষা শিখুন: ফিন্যান্স হলো টাকার ভাষা। যারা এই ভাষা বোঝে, তারাই এই খেলায় জিততে পারে।
পর্বতের চূড়া এবং জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা
কোডি একটি পর্বতারোহণের গল্প বলেন, যেখানে তিনি চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে ফিরে এসেছিলেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন যে, তিনি অন্যদের খুশি করার জন্য বা নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করার জন্য এই কষ্টকর আরোহণ করছিলেন, নিজের আনন্দের জন্য নয়।
জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসিকতার পরিচয় হলো, যে পর্বত আপনার নয়, সেই পর্বত আরোহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া। অন্যের চাপিয়ে দেওয়া লক্ষ্যের পেছনে না ছুটে নিজের পথ বেছে নেওয়াই সত্যিকারের স্বাধীনতা।(সংগৃহীত)