।।আলি শরিয়তি উবাচ।।
দেশব্যাপী এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হয়ে গেল। কিন্তু কেন?
১৬ই জুলাইয়ের আগে থেকেই এনসিপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সামাজিক মাধ্যমে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধি গুঁড়িয়ে দেবার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে গত ৫ই ফেব্রুয়ারি রীতিমত ঘোষণা দিয়ে এবং সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকেও বঙ্গবন্ধুর কবর গুঁড়িয়ে দিবে, ড. ইউনূস ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তাঁদের মনে এমন বাসনার জন্ম নেয়। যা গত প্রায় এক বছরে তাঁরা বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি ও লেখালেখিতে স্পষ্ট করেছে।
এসব ক্ষেত্রে সরকার কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং পৃষ্ঠপোষকের দায়িত্ব পালন করেছে। ফলে গোপালগঞ্জের মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জে জনসভার নামে মূলত বঙ্গবন্ধুর সমাধি গুঁড়িয়ে দিবে। সত্যি বলতে এই পরিকল্পনাও তাঁদের ছিল।
২.
এহেন পরিস্থিতিতে গোপালগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। সরকারের আনুপূর্বিক আচরণে জনতাও জানতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আক্রমণ করবে, মারধর করবে, গুলি করবে এবং মেরেও ফেলবে। তাঁরা এই ঝুঁকি নিয়েই জাতির পিতার সমাধি রক্ষায় ছুঁটে এসেছিল। রাস্তায় নেমেছিল। ৫টি লাশ ও অগণিত আহত এবং সমস্ত গোপালগঞ্জবাসীর উপরে নেমে আসা বর্বর অত্যাচার ও নিপীড়নের বিনিময়ে জাতির পিতার সমাধি রক্ষা পেয়েছে।
জাতির পিতার সমাধি রক্ষা করতে পারলেও ৫টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে তাঁরা মারা গেছে, শহিদ হয়েছে। যদিও প্রকৃত সংখ্যা এখনও অনির্ণীত। আহতের সংখ্যাও অগণিত এবং প্রায় সকলেই গুলিবিদ্ধ। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বঙ্গবন্ধুর সমাধি রক্ষায় যারা রাস্তায় নেমেছিল তাঁদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। সকলেই একটি প্রান্তিক জনপদের সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর। যারা ছিল নিরস্ত্র, কারও কারও হাতে ছিল বড়জোর গ্রাম্য লাঠি, দা, কুড়াল, যা মূলত সাহস সঞ্চয়ের হাতিয়ার।
এসবের বিপরীতে নজীরবিহীনভাবে সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত একাধিক ভিডিও এবং ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায়, সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিক্ষুব্ধ জনতার ঢিলের জবাবে গুলি করছে। আটককৃত বিক্ষোভকারীর গলায় পায়ের বুট দিয়ে চেপে ধরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলতে চাইছে। বাংলাদেশ এমন ন্যাক্কারজনক আক্রমণের দৃশ্য দেখেনি অনেক বছর।
এখানে হত্যার শিকার পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যগুলো যুক্ত করে দিচ্ছি। কেন গুলি করে হত্যা করা হলো: সেই প্রশ্ন নিহত রমজান ও দীপ্তর স্বজনের ‘আমার সংসার বাঁচাবার মতো আর কেউ নাই’ ‘আমারে মা কওয়ার আর কেউ নাই’
৩.
আক্রমণের এখানেই শেষ নয়। সেনাবাহিনীর এপিসি-তে করে এনসিপি নেতাদের সরিয়ে নিয়ে যাবার পথে রাস্তার দুইপাশে উপস্থিত উৎসুক জনতার উপরে বিরামহীন গুলি চালিয়েছে সেনা সদস্যরা। এ যেন সিনেমার দৃশ্য। এতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে অসংখ্য মানুষ এবং ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু। অপর একজন একদিন পরে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। অন্যান্য গুলিবিদ্ধ অনেকেই এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, কেউ কেউ গ্রেপ্তারের ভয়ে গোপালগঞ্জ ত্যাগ করেছে এবং গোপনে কোথাও চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত ৪ জনের কারও মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেনি থানা-পুলিশ। ‘উপর মহলে’র নির্দেশনায় ময়নাদন্তও করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখানে বুঝতে সমস্যা হয় না ‘উপর মহল’ কে ও কারা। আর কেন এ নির্দেশনা। ফলে পরিবারের সদস্যরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন ও সৎকার করতে বাধ্য হয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব যথারীতি মিথ্যা ও মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সেনাবাহিনীকে দিয়ে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করা সম্ভব হলো, কিন্তু সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা যায়নি, এটা কাল্পনিক ও অবাস্তব গল্প। যা প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেছেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, গোপালগঞ্জের এই বাস্তবতাকে রাজধানীর কর্তাব্যক্তিরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিবৃতিতে সম্পূর্ণ দোষ দেয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের উপরে, সকল দায় দেয়া হয়েছে গোপালগঞ্জবাসীর উপর। খোদ রাষ্ট্রের তরফ থেকে কেবল একটি জেলার সকল মানুষকে দোষী সাবস্ত্য করার এই প্রচেষ্টা হিটলারকেও হার মানায়।
এদিকে সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করার কথা জানানো হয়েছে। গোপালগঞ্জের সহিংস ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের কমিটি। যে প্রশসাসনের নির্দেশে গুলি চালানো হয় সেই প্রশাসনই করবে তদন্ত। মানুষের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মূলত প্রধান উপদেষ্টার বিবৃতির প্রতিফলন ঘটবে। যেখানে থাকবে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট গল্পে ভরা কথামালা।
তাছাড়া তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিকে। যিনি হিযবুত তাহরীর নামক একটি নিষিদ্ধ ও জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
একই দিনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও একটি বিবৃতি দিয়ে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছে। গোপালগঞ্জের ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য। যেখানে গোপালগঞ্জবাসীকে ‘সন্ত্রাসী ও আক্রমণকারী’ এবং সেনাবাহিনী ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এমন একটি ছবি বা ভিডিও নেই, যেখানে জনগণ সেনাবাহিনীর উপরে হামলা করেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই বিবৃতিও মিথ্যা ও চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্য বৈ কিছু নয়।
প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে ৫ জন মানুষের নিহতের বিষয়ে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। এমনকি সরকারের তরফ থেকে অন্য কেউ-ই সহানুভূতি বা দুঃখ প্রকাশের মতো ঘটনাও চোখে পড়েনি। এমন অমানবিক রাষ্ট্রযন্ত্র বহুদিন দেখেনি বাংলাদেশের মানুষ।
৪
১৬ই জুলাইয়ের প্রতিবাদ, গুলি, খুন, আহত ইত্যাদির পরে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। সমগ্র গোপালপগঞ্জে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ১২ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সামরিক ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের আতঙ্কে গোপালগঞ্জের মানুষ দিশেহারা। যাকে বলা যায় গণগ্রেপ্তার ও গণনির্যাতন। আর ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট থেকে যেভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে তাকে গণহত্যা বলাই সমীচীন ও আইনগতভাবে সঠিক।
এই কারফিউ জারির সাথে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ক্যাঙ্গারু কোর্টে ফাঁসি দেবার অনেক মিল পাওয়া যায়। সমগ্র দেশ ও বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রেখে রাতের আঁধারে যা খুশি তাই করা হচ্ছে এবং তা কালাকানুন প্রয়োগের মাধ্যমে। জিয়াউর রহমান ছিল সামরিক শাসক, আর ড. ইউনূস বেসামরিক শাসক। কিন্তু দুজনের কার্যক্রমে চমৎকার মিল।
আরেকটি বিষয় হলো- বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা যারপর নাই লজ্জাজনক। ৫টি তাজা প্রাণ ঝরে গেলো, কিন্তু সকল দায় দেয়া হলো মৃতদের উপরে, সকল দায় দেয়া হলো প্রতিরোধকারিদের উপরে, সকল দায় দেয়া হচ্ছে গোপালগঞ্জবাসীদের উপরে। তাঁদের ভাষ্যমতে, কোন প্রতিবাদ না করে, বিক্ষোভ না করে যদি নির্বিঘ্নে বঙ্গবন্ধুর কবর গুঁড়িয়ে দিতে সহযোগিতা করা হতো সেটা হতো উত্তম ফয়সালা। এহেন মগজ ও নিতম্ব বর্গা দেয়া তথাকথিত সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম বাংলাদেশের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা সেই ভাবনা ভাবীকালের জন্য তোলা রইল।
শেষাংশঃ
বাংলাদেশে এখন একটি ক্রান্তিকাল চলছে। যেখানে আওয়ামী লীগের কর্মী, সমর্থক এবং ইউনূস সরকার ও সরকারী দলসমূহের বিরোধিতাকারীদের বিভিন্নভাবে হত্যাযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। সরকার ও সরকারী বাহিনীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে, আর প্রতিবাদ না করলে বঙ্গবন্ধু ভবনের মতো সবকিছু বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের গন্তব্য কি হবে তা এখনও অনিশ্চিত। তবে এভাবে যে একটি দেশ ও সরকার চলতে পারে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার স্পষ্টতই দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তাছাড়া গোপালগঞ্জের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মূলত দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রতিবাদ। যারা মুখ ফোঁটে কথা বলতে পারছে না, কলম দিয়ে লিখতে পারছে না, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করেছে গোপালগঞ্জের সাহসী মানুষেরা। সরকার যত দ্রুত এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবে, তত দ্রুত দেশের মঙ্গল হবে।