।।লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) অভয় কৃষ্ণ।।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে রাখাইন করিডোর গত কয়েক বছরের ব্যবধানে অত্যন্ত দ্রুতই একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর অঞ্চল হয়ে উঠেছে। বাইরে থেকে দেখলে এই করিডোরকে উত্তর রাখাইনে মানবিক সহায়তার পথ বলা হলেও, ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে ভূ-রাজনীতির অনেক গভীর ও কৌশলগত উদ্দেশ্য। যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ এবং শঙ্কায় এর সার্বভৌমত্ব।
বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, ফলে এই করিডোরটি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ময়দানে পরিণত হয়েছে। আর এর মাঝে বাংলাদেশ পড়ে গেছে এই উত্তেজনাপূর্ণ খেলায়। বাংলাদেশের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো।
মানবিকতার ছদ্মবেশে কৌশলী ফাঁদ
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে, এই করিডোরটি উত্তর রাখাইনের প্রায় ২০ লাখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য সাহায্য পৌঁছানোর রাস্তা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজার সফরে গিয়ে মানবিক সাহায্যে বিঘ্ন ঘটার ঘটনাকে “অপরাধ” আখ্যা দিয়ে দরদভরা কথাবার্তাও বলে এসেছেন।
কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকদের মতে, এই মানবিক আখ্যানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশল রয়েছে—যার লক্ষ্য বঙ্গোপসাগরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার। যা দীর্ঘদিন ধরেই বলে এসেছিলেন বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেসময় এসব কথাকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ আখ্যা দিয়ে অনেকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন।
জাতিসংঘ-যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব অনুযায়ী এই করিডোর চালু করার বিষয়টি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এই করিডোরকে “রক্তাক্ত করিডোর” আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ধারণা, এই করিডোরের মাধ্যমে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চীনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় (মিয়ানমারে) আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পাবে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীকে অগ্রাহ্য করে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন চাপের মুখে করিডোর নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে ড. ইউনূসের পশ্চিমাপ্রীতি- বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক স্বার্থের কথা উল্লেখ করেন বিশ্লেষকরা।
সর্বোপরি, সেনাবাহিনী করিডোরকে ফাঁদ হিসেবেই দেখছে। জেনারেল ওয়াকার ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করছেন, যা ইউনূস সরকারের ক্ষমতার কালক্ষেপণের কৌশলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
এই দ্বন্দ্ব কিন্তু অপ্রত্যাশিতও নয়। জেনারেল ওয়াকার ৮০’র দশকের পাকিস্তানের ইতিহাস টেনে আনেন— যেখানে সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদদের মার্কিন সমর্থনের বিষয়টি পরবর্তীতে পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হয়। জঙ্গিবাদ পাকিস্তানকে ঘুণপোকার মত শেষ করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে মার্কিন মদদে রাজনৈতিক ইসলামিকরণ, গোয়েন্দা হস্তক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার কথা সকলেই জানেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাই রাখাইন করিডোরকে “আফগানিস্তানের কৌশল” পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা হিসেবে দেখছে। এই করিডোরও বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে, যা সেনাবাহিনী টের পাচ্ছে।
চীনের আলাদা হিসাব-নিকাশ
চীনের জন্যেও এই করিডোর একটি বড় মাপের কৌশলগত হুমকি। কারণ, চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর-এর মূল অংশ হচ্ছে রাখাইনের কিয়াকফিউ বন্দর—যা মালাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে চীনের জন্য একটি লাভজনক এবং বিকল্প রুট। যদি এই করিডোরে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে, তবে এই অঞ্চলে চীন কৌশলগত দাপট হারাবে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। একইসাথে আরাকান আর্মি-সহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতাও চালিয়ে যাচ্ছে।
ফলে এই করিডোর যদি আরাকান আর্মিকে আরও ক্ষমতাবান করে তোলে, তবে চীন একে নিজের জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখবে।
ভারতের নীরব ভূমিকা
এখানে ভারতের অবস্থান বেশ জটিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সকল পর্যায়ের সম্পর্ক ও সহযোগিতার প্রয়োজন হলেও, বাস্তবে দিল্লির উদ্বেগ চীনের মতোই।
ভারত কালাদান প্রকল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, ফলে রাখাইনে স্থিতিশীলতা দরকার তার নিজের স্বার্থে। একইসঙ্গে, ভারত চায় না যে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভারতের জন্য সংবেদনশীল উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করুক। তাই এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবস্থান এক বিন্দুতে মিলে গেছে। তাই তারা চায় আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের কৌশলগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে। এতে পশ্চিমা প্রভাব ঠেকানো যেতে পারে এবং ভবিষ্যতে আরাকান আর্মি বা মিয়ানমারের চিন রাজ্যের বিদ্রোহীদের সঙ্গে নিজস্ব চ্যানেলে যোগাযোগও রাখতে পারবে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবরে এসেছে যে, ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আরাকান আর্মি প্রতিনিধিদের সাথে মিজোরামে দেখা করেছেন। সেখানে ভারত নন-লেথাল সহায়তা ও কূটনৈতিক যোগাযোগ রেখেছে, কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ নেয়নি।
আরাকান আর্মির উত্থান এবং ঝুঁকি
আরাকান আর্মি এখন রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণে এবং নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সেখানে শাসন চালাচ্ছে। কিন্তু এই আধিপত্যের কিছু বড় ঝুঁকিও রয়েছে। যদি করিডোরের মাধ্যমে সহায়তা আরাকান আর্মি-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যায়, তবে এটা হবে বিদ্রোহীদের স্বীকৃতি প্রদান—যা মিয়ানমারের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ক্ষুন্ন করতে পারে এবং এ অঞ্চলটিকে একপ্রকার প্রক্সি যুদ্ধের মঞ্চ বানিয়ে দিতে পারে।
আর বাংলাদেশের জন্য এর অর্থ—সহিংসতার কেন্দ্রে জড়িয়ে পড়া এবং চীন ও মিয়ানমার—উভয়েরই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করা।
প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদ
এই করিডোরকে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে, তার কারণ এটি ভবিষ্যতের প্রক্সি সংঘাতের মডেল হতে পারে। মানবিক সহায়তা এখানে এক ছদ্মবেশ মাত্র, যার আড়ালে আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রভাব বিস্তার।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একে ফাঁদ হিসেবে দেখছে, চীন একে তার পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ মনে করছে, আর ভারত একে নিজের মতো করে দেখতে চায়। আরাকান আর্মিও এসব ঘটনাচক্রকে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে।
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওপরে ওপরে এই করিডোর নিয়ে খুব আগ্রাসী মনোভাব না দেখালেও ২০২২ সালের Burma Act এবং ওয়াশিংটনে ক্রমবর্ধমান লবিং এ ব্যাপারে মার্কিন আগ্রাসন স্পষ্ট করে তুলেছে।
পরবর্তী পদক্ষেপের ওপরেই নির্ভর করছে পরিণতি
আগামী কয়েক মাসের পদক্ষেপগুলো বঙ্গোপসাগরের আগামী দশকের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট নির্ধারণ করে দেবে। যেমন-
যদি বাংলাদেশ করিডোর অনুমোদন করে, তাহলে সেনাবাহিনীর ওপর চাপ বাড়বে—এমনকি অভ্যন্তরীণ সংঘাতও হতে পারে।
আর যদি সেনাবাহিনী নির্বাচন চায় এবং করিডোর প্রত্যাখ্যান করে, তবে ভারত ও চীনের সাথে নীরব একজোট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন ভারত রাখাইনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে।
ভারতের জন্য জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে সমর্থন দেওয়াটাই হবে বাস্তবধর্মী কৌশল—এতে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সুরক্ষিত থাকবে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং তারা মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যত দরকষাকষিতে নেতৃত্বে থাকতে পারবে।
অন্যদিকে, করিডোর ব্যর্থ হলে চীনের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব ধরে রাখা, কিয়াকফিউ রক্ষা করা এবং মার্কিন অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হবে।
পরিশেষ: করিডোর নয়, এটি এক যুদ্ধের ছক
রাখাইন করিডোর আদতে মানবিক সহায়তার রাস্তা নয়—এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন এক প্রতিযোগিতার প্রতিচ্ছবি। এই যুদ্ধ আর যুদ্ধজাহাজের মাধ্যমে নয়, বরং সরবরাহ, প্রভাব ও অবকাঠামোর মাধ্যমে হচ্ছে।
বাংলাদেশ এই খেলায় একটি নগণ্য ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে— যে পক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে, তারাই নির্ধারণ করে দেবে এই দেশ নিজের মতো থাকবে, না কি বাইরের শক্তির খেলায় ব্যবহৃত হবে।
এখানে ঝুঁকিতে শুধু মানবিকতা নয়, বরং আঞ্চলিক শৃঙ্খলার ভবিষ্যৎ—কে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বজায় রাখবে, রাখাইন বন্দরে কার পতাকা উড়বে এবং ভবিষ্যতে আরেকটি করিডোর কে নিয়ন্ত্রণ করবে।
ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদেরা হয়তো এই রাখাইন করিডোরকে দেখবেন হয়তো এক সাহসী সহায়তার সেতু হিসেবে, অথবা কৌশলগত ফাঁদের একটি খোলা দরজা হিসেবে।
শেষ কথা: খেলা এখনো শুরু মাত্র—ঢাকা, দিল্লি, বেইজিং, ওয়াশিংটন—সবাই মাঠে নেমেছে, আর দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
লেখক: পরিচিতি: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সামরিক বিশ্লেষক।