।। আমিনুল ইসলাম জুয়েল।।
জাপানে পড়তে যাওয়া এক ছাত্রী একদিন দেশে ফোন করে বলল,…
– খুব লজ্জায় আছি!
– কেন, কী হয়েছে?
– ড্রইং ক্লাসে ড্রইং বক্স নিয়ে যাইনি।
– তো?
– জাপানি স্যার একটা বড় শিক্ষা দিয়েছেন।
– কী করেছেন?
– আমার কাছে এসে ক্ষমা চেয়েছেন! বলেছেন, আজ যে ড্রইং বক্স নিয়ে আসতে হবে, তা স্মরণে রাখার মতো জোর দিয়ে তিনি আমাকে বলতে পারেননি। তাই তিনি দুঃখিত।
– হুম।
– আমি তো আর কখনো ড্রইং বক্স নিতে ভুলব না। আজ যদি তিনি আমাকে বকতেন বা অন্য কোনো শাস্তি দিতেন, আমি হয়তো কোনো একটা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতাম!
জাপানি দল বিশ্বকাপে হেরে গেলেও
জাপানি দর্শকরা গ্যালারি পরিষ্কার করে তবেই স্টেডিয়াম ত্যাগ করে।
এ আবার কেমন কথা?
এটা কি কোনো পরাজয়ের ভাষা! হেরেছিস যখন, রেফারির চৌদ্দ গুষ্টি তুলে গালি দে। বলে দে, পয়সা খেয়েছে।
বিয়ারের ক্যান, কোকের ক্যান, চীনাবাদামের খোসা যা পাই ছুঁড়ে দে। দুই দিন হরতাল ডাক।
অন্তত বুদ্ধিজীবীদের ভাষায় এটা তো বলতে পারিস যে, খেলোয়াড় নির্বাচন ঠিক হয়নি; এতে সরকার বা বিরোধী দলের হাত আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে
জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আমেরিকার প্রতিনিধি ম্যাক আর্থারের কাছে গেলেন।
প্রতীক হিসেবে নিয়ে গেলেন এক ব্যাগ চাল।
হারাকিরির ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে মাথা পেতে বললেন,
“আমার মাথা কেটে নিন, আর এই চালটুকু গ্রহণ করুন। আমার প্রজাদের রক্ষা করুন। ওরা ভাত পছন্দ করে। ওদের যেন ভাতের অভাব না হয়!”
আরে ব্যাটা, তুই যুদ্ধে হেরেছিস, তোর আত্মীয়স্বজন নিয়ে পালিয়ে যা।
তোর দেশের চারদিকেই তো জল। নৌপথে কিভাবে পালাতে হয়, আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নে।
কোরিয়া বা তাইওয়ান যা, ওখানকার মীরজাফরদের সাথে হাত মেলা। সেখান থেকে হুঙ্কার দে।
সম্রাট হিরোহিতো এসব কিছুই করলেন না।
তার এই আচরণ আমেরিকানদের পছন্দ হলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত মহানায়কদের মধ্যে কেবলমাত্র হিরোহিতোকেই বিনা আঘাতে বাঁচিয়ে রাখা হলো।
২০১১ সালের ১১ই মার্চ
সুনামির আগমনবার্তা শুনে এক ফিশারি কোম্পানির মালিক সাতো সান প্রথমেই বাঁচাতে গেলেন তার কর্মচারীদের।
হাতে সময় মাত্র ৩০ মিনিট।
প্রায়োরিটি দিলেন বিদেশি চাইনিজদের।
একে একে সব কর্মচারীকে অফিস থেকে বের করে পাশের উঁচু টিলায় নিজে পথ দেখিয়ে রেখে এলেন।
সর্বশেষে গেলেন তার পরিবারের খোঁজ নিতে।
ইতিমধ্যে সুনামি এসে হাজির।
সাতো সানকে চোখের সামনে পরিবারসহ কোলে তুলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সুনামি!
আজও খোঁজহীন হয়ে আছেন তার পরিবার।
ইস! সাতো সান যদি একবার বাঙালিদের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন, তাহলে শিখতে পারতেন – ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম!’
সাতো সান অমর হলেন চায়নাতে।
চাইনিজরা দেশে ফিরে গিয়ে শহরের চৌরাস্তায় ওনার প্রতিকৃতি বানিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।
নয় বছরের এক ছেলে
স্কুলে ক্লাস করছিল।
সুনামির সতর্ক সংকেত শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানাল এবং সব ছাত্রকে নিয়ে তিন তলায় জড়ো করল।
তিন তলার ব্যালকনি থেকে সে দেখল তার বাবা স্কুলে আসছে গাড়ি নিয়ে।
গাড়িকে ধাওয়া করে আসছে প্রলয়ংকারী জলের সৈন্যদল।
গাড়ির স্পিড জলের স্পিডের কাছে হার মানল।
চোখের সামনে নেই হয়ে গেল বাবা!
সৈকতের কাছেই ছিল তাদের বাড়ি।
শুনল, মা আর ছোট ভাই ভেসে গেছে আরো আগে।
পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ছেলেটি আশ্রয়শিবিরে উঠল।
শিবিরের সবাই ক্ষুধা আর শীতে কাঁপছে।
ভলান্টিয়াররা রুটি বিলি করছে। আশ্রিতরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।
ছেলেটিও আছে সবার সাথে।
এক বিদেশি সাংবাদিক দেখলেন, যতখানি রুটি আছে, তাতে লাইনের সবার হবে না।
ছেলেটির কপালে খাবার জুটবে না ভেবে, সাংবাদিক নিজের ভাগের রুটি দুটো ছেলেটিকে দিলেন।
ছেলেটি ধন্যবাদ জানিয়ে রুটি গ্রহণ করল,
তারপর যেখান থেকে রুটি বিলি হচ্ছিল, সেখানেই রুটিগুলো ফেরত দিয়ে আবার লাইনে এসে দাঁড়াল।
সাংবাদিক কৌতূহল চাপতে পারলেন না।
জিজ্ঞেস করলেন, “এ কাজ কেন করলে খোকা?”
খোকা উত্তর দিল,
“বন্টন তো ওখান থেকে হচ্ছে। ওদের হাতে থাকলে বন্টনে সমতা আসবে। তাছাড়া লাইনে আমার চেয়েও বেশি ক্ষুধার্ত লোক থাকতে পারে!”
সহানুভূতিশীল হতে গিয়ে বন্টনে অসমতা এনেছেন, এই ভেবে সাংবাদিকের পাপবোধ হলো।
ওই ছেলের কাছে কী বলে ক্ষমা চাইবেন, ভাষা হারালেন তিনি।
যাদের জাপান সম্পর্কে ধারণা আছে,
তারা সবাই জানেন,
যদি ট্রেনে বা বাসে কোনো জিনিস হারিয়ে যায় – আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
ওই জিনিস আপনি অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাবেন।
গভীর রাতে কোনো ট্রাফিক নেই,
কিন্তু পথচারীরা ট্রাফিক বাতি সবুজ না হওয়া পর্যন্ত পথ পার হচ্ছেন না।
ট্রেনে-বাসে টিকিট ফাঁকি দেওয়ার হার শূন্যের কোঠায়।
একবার ভুলে ঘরের দরজা লক না করে এক প্রবাসী দেশে গেলেন।
মাসখানেক পর এসে দেখেন, যেমন ঘর রেখে গেছেন, ঠিক তেমনই আছে!
এই শিক্ষা জাপানিরা কোথায় পান?
সামাজিক শিক্ষা শুরু হয় কিন্ডারগার্টেন লেভেল থেকেই।
সর্বপ্রথম যে তিনটি শব্দ এদের শেখানো হয় তা হলো:
কননিচিওয়া (হ্যালো): পরিচিত মানুষকে দেখা মাত্র হ্যালো বলবে।
আরিগাতোউ (ধন্যবাদ): কারো দ্বারা উপকৃত হলে কৃতজ্ঞতা জানাবে।
গোমেননাসাই (দুঃখিত): ভুল করলে ক্ষমা চাইবে।
এগুলো শুধু মুখস্ত শেখানো হয় না, বরং বাস্তব জীবনেও শিক্ষকরা এগুলো ব্যবহার করেন এবং শিক্ষার্থীদের করিয়ে ছাড়েন।
এই তিনটি শব্দ দিয়ে ওরা শেখে সহানুভূতি, কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ববোধ।
স্বনির্ভরতার ট্রেনিংও শুরু হয় শৈশবেই।
নিজের বই-খাতা, খেলনা, পোশাক, বিছানা – নিজেই গুছাতে শেখে।
টয়লেট ব্যবহার শেষে নিজের হাত ও জায়গা পরিষ্কার করা শেখে।
খাবার খেয়ে নিজের প্লেট নিজেই ধোয়।
প্রাইমারি স্কুল থেকেই দল বেঁধে স্কুলে যাওয়া শেখানো হয়।
স্কুল কর্তৃপক্ষই দল গঠন করে।
ট্রাফিক আইন, গণপরিবহনে চড়ার নিয়ম শেখানো হয়।
আপনার গাড়ি আছে বলে বাচ্চাকে স্কুলে দিতে গেলে সম্মান বাড়ে না, বরং লজ্জা পেয়ে আসতে হয়।
ক্লাস সেভেন থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়।
ক্লাসে কে ধনী-গরীব, কে প্রথম-দ্বিতীয় – এসব বৈষম্য যেন না হয়, সে বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট সতর্ক।
রোল নম্বর হয় নামের আদ্যাক্ষরের ভিত্তিতে, পারফরম্যান্স নয়।
বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও হয় দলভিত্তিক।
লাল, নীল, সবুজ, হলুদ – এমন কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সব ছাত্রছাত্রী একসাথে কাজ শেখে।
এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকেও দলবদ্ধভাবে কাজের অভ্যাস গড়ে ওঠে।
এই জন্যই হয়তো জাপানে তথাকথিত ‘লিডার’ তৈরি হয় না,
তবে তারা সবাই মিলে গড়ে তোলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় “লিডারশিপ জাতি”!