বাংলাদেশি-আমেরিকান ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শফিউর রহমান ফারাবীর জামিন মঞ্জুর হয়েছে। ঢাকার একটি আদালত গতকাল মঙ্গলবার এই আদেশ দিয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র বিতর্ক ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। জনগণের একাংশ এই জামিনকে জঙ্গি ও খুনিদের ধারাবাহিকভাবে মুক্তি পাওয়ার প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখছে।
ঘটনার পটভূমি
অভিজিৎ রায়, মুক্তমনা ব্লগিং প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং মুক্তচিন্তার প্রবক্তা, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় একুশে বইমেলায় অংশ নেওয়ার সময় উগ্র মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে নৃশংসভাবে খুন হন। এই হামলায় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর আহত হন। হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)।
২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবুর রহমান পাঁচজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ফারাবীকে এই মামলায় মৃত্যু হুমকি দেওয়া এবং হত্যাকাণ্ডে সহায়তার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
ফারাবী, একজন কট্টরপন্থী ব্লগার এবং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য, অভিজিৎকে একাধিকবার ফেসবুক ও ব্লগে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি অভিজিৎ রায়ের ব্যক্তিগত তথ্য, যার মধ্যে তার অবস্থানও ছিল, হত্যাকারীদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন বলে পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত হয়। ২০১৫ সালের ২ মার্চ র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত পোস্ট অনুযায়ী, ফারাবীর জামিন মঞ্জুর হয়েছে, এবং আশা করা হচ্ছে তিনি শীঘ্রই মুক্তি পাবেন। @mdjashim197 নামে একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “আলহামদুলিল্লাহ্, ফারাবি ভাইয়ের জামিন মঞ্জুর হয়েছে। আদালত বেল আদেশ দিয়েছেন। আশা করি দ্রুত তিনি বাইরে চলে আসবেন।” এছাড়া, @AdvMA_Rahman নামে আরেকজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “অবশেষে যে মামলাটি নিয়ে এত বছর আমরা সংগ্রাম করলাম তাতে ফারাবীকে জামিন দেয়া হয়েছে।” তবে, এই জামিন কোন মামলায় দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়, কারণ ফারাবী অভিজিৎ হত্যা মামলা ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে আরেকটি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
জনমত ও সমালোচনা ফারাবীর জামিনের খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে এই সিদ্ধান্তকে জঙ্গি ও খুনিদের ধারাবাহিকভাবে মুক্তি দেওয়ার প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখছেন। এক্স-এ একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “একের পর এক জঙ্গি ও খুনিরা জামিন পাচ্ছে। এটা কি বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা, নাকি রাজনৈতিক চাপের ফল?” অপর একটি পোস্টে বলা হয়, “অভিজিৎ রায়ের হত্যার মতো নৃশংস ঘটনার দোষীদের জামিন দেওয়া মুক্তচিন্তা ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি।”
অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, ২০২১ সালে তদন্তে স্বচ্ছতার অভাব এবং শুধুমাত্র কয়েকজন নিম্নস্তরের আসামিকে শাস্তি দেওয়ার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ছয় বছরে তদন্তকারী কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, অথচ আমি হামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ও ভুক্তভোগী। শুধুমাত্র কয়েকজন পদাতিক সৈনিককে শাস্তি দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ও মূল কারণ উপেক্ষা করা হচ্ছে।”
অভিজিৎ হত্যা মামলায় পাঁচজন আসামি—সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক (মেজর জিয়া), মোজাম্মেল হুসাইন, আবু সিদ্দিক সোহেল, আকরাম হোসেন ও আরাফাত রহমান—মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, যদিও মেজর জিয়া ও আকরাম এখনো পলাতক। ফারাবী ছিলেন একমাত্র আসামি যিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন। তবে, ফারাবীর জামিনের সিদ্ধান্ত কি শুধুমাত্র আইসিটি আইনের মামলার জন্য, নাকি অভিজিৎ হত্যা মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত, তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট নয়।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হ্যাকার গ্রুপ সিস্টেম অ্যাডমিনবিডি অন্তর্বর্তী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ফারাবীর মুক্তির দাবি জানিয়েছিল। এই ঘটনা রাজনৈতিক ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য চাপ বা প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।
অভিজিৎ রায়ের হত্যা বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়। তার মৃত্যুর পর দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছিল। ফ্রিডম ফ্রম রিলিজন ফাউন্ডেশন ২০১৮ সালে অভিজিৎ রায় সাহসিকতা পুরস্কার প্রবর্তন করে, যা মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী চর্চাকে উৎসাহিত করে। ফারাবীর জামিনের খবর এই পুরস্কারের মর্ম এবং অভিজিৎ রায়ের স্মৃতির প্রতি অপমান হিসেবে অনেকে মনে করছেন।
শফিউর রহমান ফারাবীর জামিন মঞ্জুরের ঘটনা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। এই সিদ্ধান্ত কীভাবে মুক্তচিন্তার সমর্থকদের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। জামিনের আইনি বিস্তারিত এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জানতে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ও তদন্তের অগ্রগতির দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।