।। আফজাল হোসেন।।
আমাদের চাওয়া কি? দেশের ভালো হোক, দেশের মানুষ ভালো থাকুক। অনেকদিন থেকে সামান্যই চাওয়া। কখনোই এ চাওয়া, আশা পূরণ হয়নি। হবে হবে মনে হয়- হয় না। সেই গাধার সামনে মুলা ঝুলিয়ে দেয়া গল্পের মতো। ঝোলানো মুলা পাবে বলে গাধা দৌঁড়ায়, দৌঁড়ে দৌঁড়ে হয়রাণই হয়।
যখন যিনি মহাজন হতে পেরেছেন, জনগনকে শুনিয়েছেন, আমরা অমুক তমুক নই- আমরা আলাদা, অতি বিশেষ। এই দেশকে বানিয়ে দেবো সোনার দেশ, মানুষের হৃদয় পূর্ণ করে দেবো ভালো আর আলোতে, দেশবাসী থাকবে শান্তিতে- ফেলতে পারবে স্বস্তির নিশ্বাস।
মুখস্ত করা মধুর কথা শিমূল তুলার মতো বাতাসে উড়তে উড়তে একসময় উধাও হয়ে যায়।
ক্ষমতা খুবই ভয়ানক। দেহ, মন মানসিকতায় চর্বি জমিয়ে দেয়- মানুষ হয়ে যায় অন্য মানুষ। চর্বি জড়ানো মন কেবল নিজেকে চিনতে পারে, নিজের অনুগত মানুষদের চিনতে পারে- অচেনা হয়ে যায় দেশ, দেশের বাকি মানুষেরা, যাদেরকে বলা হয় সাধারণ।
সাধারণেরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখে, ক্ষমতাবান চোখ রাঙাচ্ছে, ধমক দিচ্ছে, গায়ের জোর দেখিয়ে জানান দিচ্ছে, এটাই ক্ষমতা। সাধারণেরা নিজ দেশে, নিজের মাটিতে এভাবেই চিরদিন অদরকারি বনে গেছে।
কখনোই এই তিক্ত নিয়মের বদল ঘটেনি। এমন কথা উচ্চারণ করা, উল্লেখ করা সর্বদা বড় আকারের দোষের হয়েই থেকেছে। শাষক তো মানুষই- তাহলে তাঁদের মন থেকে সংবেদনশীলতা লোপ পেয়ে যায় কেনো? নিজেদেরকে অন্য কাতারের ভাবতে পছন্দ করে তাঁরা। ভাবে, আমরা আলাদা মর্যাদার, সর্বদা সকল সাধারণকে তা মেনে, বজায় রেখে চলতে বলতে হবে। শাষককে মোটেও অস্বস্তি, অশান্তির মুখোমুখি করা যাবে না। তেমন ঘটনা ঘটলে অতি মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ, জনগনকে।
চুয়ান্ন বছর ধরে দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়নি। থেকেছে একই রকম। মসনদে আসীনদের সমালোচনাকে কটু, দুষ্ট মন্তব্য বলে ভাবা হয়ে থাকে। আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ধন্য মানুষেরা এসব সহ্য করে না। আনুগত্য বোঝাতে নিজের ভাই, বন্ধু, প্রতিবেশীকেও শত্রু বিবেচনা করে। হামলে পড়ে বুঝিয়ে দেয়- এটাই শাষন, ক্ষমতা।
আনুগত্য এক প্রকার মোহ বা অন্ধত্ব- সে মোহ, অন্ধত্বে আচ্ছন্ন মন অন্যের দোষ বড় করে দেখতে শেখায়। আজ অবধি কোন দল সিংহাসন হারিয়ে বলেনি, আমাদের ভুল ছিল! সবসময় সমস্ত ভুল চাপানো হয়েছে সাধারণের উপর। সাধারণেরা হয়েছে দোষী, অবুঝ, অপদার্থ- ভালো মন্দ বুঝতে অক্ষম এক সম্প্রদায়।
কালে কালে সিংহাসন হারানোরা ক্রোধে, ক্ষোভে দায়ী করেছেন আর এক অদৃশ্য পক্ষ- ছায়া শত্রুকেও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ছায়া শত্রুর সাথে লড়ে লড়ে ক্লান্ত জনগন। জনগন সদাই রয়েছে দু ধারি তলোয়ারের মুখোমুখি। চুপ থেকে রক্তাক্ত হতে হয়, বিরক্তি প্রকাশ করলেও নিস্তার মেলে না।
যার যখন সময়- নিজেরাই নিজেদেরকে যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করেছেন। এমন অন্ধত্ব কাউকে কখনোই সত্য কী বা যথার্থ ভূমিকা কী হওয়া উচিৎ- তা বুঝতে দেয়নি। সকলেই মনে করেছেন, তাঁরা দেশ ও মানুষের জন্য বহুকিছু করেছেন কিন্তু দলের কর্মী সমর্থকেরা ছাড়া সে মহান অবদানের কথা বোকা জনগন বুঝতে পারে নি।
সিংহাসনের মানুষ কেবল জয়ধ্বনি পছন্দ করে। অপছন্দ বা বড় ছোট- যে কোনো মাপের সমালোচনায় তাঁরা প্রবল বিরক্ত হন, রাগ করেন এবং শক্ত হাতে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। নিজ দলের মানুষদের মিত্র আর বাকি সবাইকে শত্রু মনে করেছেন তাঁরা। যুগের পর যুগ ধরে চলেছে একই চর্চা।
চুয়ান্ন বছর ধরে না বোঝার অপবাদ বয়ে বেড়াতে বেড়াতে সাধারণও এখন আর আগের মত নেই। বিশ্বাস করে ঠকতে ঠকতে সবার আত্মবিশ্বাসে ধরেছে ফাটল। হয়ে উঠেছে সন্দেহপ্রবণ। এখন নিয়ত কানকথাতে বহু মানুষ বিপর্যস্ত হয়। বিশ্বাস করে এবং বাড়তি হতাশায় আক্রান্ত হয়। ভাবে, পুরো একটা জীবন খরচ হয়ে গেলো, রাজনীতির বোল চাল একটুও বদলালো না।
যদি অন্ধত্ব, চালাকির বদলে প্রেম দিয়ে দেশটার ভালো চাওয়া যেতো, অর্ধশত বছরে দেশটা নিশ্চয়ই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো। রাজনীতি করা মানুষ খুব করে রাজনীতি ভালোবাসে। দুঃখের কথা- মানুষ ও দেশ তাঁদের ভালোবাসার বিষয় হয়ে ওঠে না।
কতকাল ধরে আদর্শ স্থাপনের চেষ্টার বদলে মানুষের মধ্যে বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে- ঘৃণা, বিভেদ এবং প্রতিহিংসা। গলগল করে বেড়েই চলেছে প্রতিশোধপরায়নতা, নোংরামো, অসভ্যতার চর্চা। এসব রাজনীতি নয় কিন্তু বহু মানুষ বিশ্বাস করে- এসবই দায়িত্বশীলতা, মহান রাজনৈতিক ভূমিকা।
এমন রাক্ষুসে ভূমিকায় একদা কোনো মানুষই আর মানুষ থাকবে না। দেশটা থাকবে- সেটা কোন প্রকারের জীবের দেশ? সবাই সেখানে পরষ্পরের রক্ত ও মাথা চেয়ে বেড়াবে।
লেখক: অভিনয় শিল্পী ও নাট্যকার।