গঙ্গাচড়া আবারও রক্তে লাল। আলদাদপুর বালাপাড়ার হিন্দুদের ঘরে আগুন, মন্দিরে হাতুড়ির আঘাত, জনজীবনে আতঙ্ক। ২০১৭ সালের ঠাকুরপাড়ার পর এবারও রংপুরের মাটি কাঁপল সাম্প্রদায়িক উন্মাদদের লাঠি-বোমা-হুংকারে। অভিযোগ? ফেসবুকে নবীর অবমাননা! অভিযুক্ত? একটি ১৭ বছরের কিশোর, যে এখন জেল হাজতে। প্রমাণ? শূন্য। তদন্ত? অনুপস্থিত। বিচার? রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে-মুখে কালো পট্টি বাঁধা।
এই বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার অর্থই হলো—নিজের বাড়িতে শঙ্কিত প্রাণী হয়ে থাকা। একজনের হয়তো করা “অপরাধে” পুরো একটি সম্প্রদায়কে জিম্মি করা, তাদের ঘর-বাড়ি পোড়ানো, মন্দির ভাঙা, নারী-শিশুদের রাস্তায় ফেলা—এটাই এখন রাষ্ট্রের “অফিশিয়াল” নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১২-র রামু, ২০১৬-র নাসিরনগর, ২০২১-র পীরগঞ্জ, আর আজকের গঙ্গাচড়া—সবখানে একই স্টেনসিলে আঁকা দগদগে ঘা।
গঙ্গাচড়ার ঘটনায় দেখা গেল, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থেকে মাইকিং করে লোক জড়ো করা হলো। কে করেছে সেই ফেসবুক পোস্ট? কে যাচাই করেছে? কারও কিছু জানার দরকার নেই। শুধু দরকার হিন্দু পাড়ায় ঢুকে “প্রতিশোধ” নেওয়া। স্কুল-মন্দির-দোকান ভাঙার পর উল্লাস করতে করতে ফিরে যাওয়া। প্রশাসন? তারা ব্যস্ত কিশোরটিকে “সুরক্ষা” দেওয়ায়—জেলে ঢুকিয়ে।
এই সহিংসতার পেছনে কাজ করে একটি সুপরিকল্পিত মনস্তত্ত্ব। সংখ্যালঘুদের বারবার টার্গেট করে তাদের ভীতসন্ত্রস্ত রাখা। দেশভাগের সময় যেমন বাংলার হিন্দুদের বাড়ি-জমি দখল হয়েছিল, আজও একই পদ্ধতি চলছে। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ২২%, এখন ৭.৯৫%। এই হার কমার পেছনে কোনো “স্বাভাবিক” কারণ নেই। আছে জোর-জুলুম, ভয় দেখানো, সম্পত্তি দখল।
রামুর উত্তম বড়ুয়া, নাসিরনগরের রসরাজ দাস—এদের কেউই আসলে কিছু করেনি। কিন্তু তাদের নামে গুজব ছড়িয়ে পুরো একটি সম্প্রদায়কে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের ভূমিকা? নিরব দর্শক। বিচার? অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যায়। ক্ষমতাসীনদের কাছে সংখ্যালঘুরা ভোটব্যাংক নয়, বরং বলির পাঁঠা।
গঙ্গাচড়ার পর কী হবে? কিছুদিন পর সবাই ভুলে যাবে। মিডিয়া নতুন খবরে চলে যাবে। ক্ষতিগ্রস্তরা হয়তো বাড়িঘর ফিরে পাবে, কিন্তু আতঙ্ক থেকে যাবে। আবার কোনো একদিন নতুন গুজবে নতুন পাড়ায় আগুন জ্বলবে। এই চক্রের শেষ নেই। কারণ, যারা এই সহিংসতার পেছনে আছে, তারা জানে—রাষ্ট্র তাদের পক্ষে।
একটি দেশ তখনই সভ্য হয়, যখন তার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের ভয়-আতঙ্কমুক্ত জীবন দিতে পারে। বাংলাদেশ সেই পরীক্ষায় বারবার ফেল করছে। রামু, নাসিরনগর, গঙ্গাচড়া—এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একটি রাষ্ট্রের নৈতিক ব্যর্থতার দলিল।( আওয়ামীলীগ পেইজ থেকে সংগৃহীত)