★গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংসের ফলে সৃষ্ট লাখো বেকারত্ব
★বকেয়া বেতনের ফলে শ্রমিক অসন্তোষ
তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানিতে সিংহভাগের অংশীদার এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা খুব ভালোভাবেই নির্ভর করে এই খাতটির উপর। কিন্তু জুলাই দাঙ্গার পর এই খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দৈনিক জনকন্ঠের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই দাঙ্গা থেকে ডিসেম্বরের শেষার্ধ পর্যন্ত ৬ মাসে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়েছে, বেকারত্ব বরণ করেছেন ৬০ হাজারের অধিক শ্রমিক। শ্রমিকদের ঠিকমত বেতন দিতে পারেনি অন্তত ১৫৮ টি কারখানা। গার্মেন্টস মালিকদের মতে, এই খাতটি ধ্বংসের পেছনে ইউনূস সরকারের পলিসিগত ব্যর্থতা জ্বালানি সংকট, ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতার জন্য শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারা ইত্যাদি ফ্যাক্টর দায়ী।
তাছাড়া কারখানা বন্ধের পেছনে আরও একটা বড় কারণ আছে, তা হলো গত ৫আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ট বা মালিকানাধীন কারখানাগুলোতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া, সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের অনেক শিল্পপতি বা তাদের ঘনিষ্ঠজন জীবনের নিরাপত্তার জন্যে দেশের বাইরে অবস্থান করায় এবং দেশের অবাধ মব-সন্ত্রাস গার্মেন্টস শিল্প-প্রতিষ্ঠান গুলোতে ধীর বা স্থবিরতার সৃষ্টি করেছে।
দৈনিক আজকালের খবরের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বৈরাচার ইউনূস ক্ষমতা দখলের পর থেকে মার্চ পর্যন্ত সাত মাসে অন্তত দেড় শতাধিক কারখানা বন্ধ এবং ছাঁটাইয়ের কারণে চাকরি হারিয়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। চট্টগ্রামে ৫২টি পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদীতে মোট ৯৫টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। দেশের মোট ১৫০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে, ফলে প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। শুধু গাজীপুরেই অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছেন।
‘বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের গ্রেফতারের পর প্রতিষ্ঠানটির ১৪টি টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া, গাজী গ্রুপের পাঁচটি টায়ার কারখানা, বেঙ্গল গ্রুপের তিনটি প্লাস্টিক কারখানাসহ আশুলিয়া, সাভার, জিরাবো ও জিরানির অনেক পোশাক কারখানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে।’- দৈনিক আজকালের খবর
দুই ঈদেই বেতন-বোনাস পায়নি পোশাক খাতের শ্রমিক ভাই ও বোনেরা। বোকেয়া বেতনের দাবিতে রাজধানীর বিজয়নগরের শ্রম ভবন ও উত্তরার বিজিএমইএ ভবনের সামনে অবস্থান করে গত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময়ে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকের দিন-রাত কেটেছে।
‘৭ জুন পবিত্র ঈদুল আজহা ছিলো। ঈদের ছুটির ২ দিন আগ পর্যন্তও অর্ধেকের বেশি কারখানায় শ্রমিকেরা বেতন-বোনাস পাননি। ১ জুন শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোট ৯ হাজারে ৬৮৩ কারখানার মধ্যে গত মে মাসের বেতন পরিশোধ করেছে মাত্র ৮৪৯টি। বকেয়া আছে ৮ হাজার ৮৩৪টির। বেতন পরিশোধের হার ৮ দশমিক ৭৭। অপরিশোধের হার ৯১ দশমিক ২৩। অন্যদিকে বোনাস পরিশোধ করেছে ৯ হাজার ৬৮৩টি কারখানার মধ্যে ৪ হাজার ২৪২টি। পরিশোধের হার ৪৩ দশমিক ৮২। অপরিশোধের হার ৫৬ দশমিক ১৯। বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের আট শিল্প এলাকায় ৩১ মে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রায় ৬৭ শতাংশ কারখানায় বোনাস পরিশোধ হয়নি।’ ( শুধু ঈদের ছুটি নয়, শ্রমিকদের বেতন-বোনাসও লাগবে, প্রথম আলো, ০২ জুন ২০২৫)
দিনের পর দিন শ্রমিকরা শ্রম ভবন এলাকায় অবস্থান করলেও প্রথমে সমস্যা সমাধানে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তীব্র গরমে অবস্থান নেওয়ায় এবং খাবারের অভাবে অনেক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। হৃদরোগে একজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সচিবালয় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। শ্রম সচিবসহ অন্য কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধও করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সমঝোতা বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু টাকা পরিশোধ এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে ঈদুল ফিতরের আগের দিন শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঈদুল আজহার আগে আবারও শ্রমভবনের সামনে অবস্থান নেন শ্রমিকরা। এবারও পূর্ণ বকেয়া পরিশোধ না হওয়ায় আন্দোলন অব্যাহত রাখার হুঁশিয়ারি দেন তারা। শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী এসব শ্রমিকদের ভাগ্যে কী আছে? সেটি নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।( কী আছে শ্রমিকদের ভাগ্যে, কোন পথে আন্দোলন? || বাংলা ট্রিবিউন || ১৫ জুন ২০২৫)
১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে আমেরিকার বাজারনির্ভর বেশিরভাগ দেশীয় পোশাক কারখানা বন্ধের ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। মোট রপ্তানি পণ্যের ১৭ শতাংশই আমেরিকায় যায়, তাই বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ যা ভারত(অতিরিক্ত ২৬% শুল্ক) ও ভিয়েতনামের(অতিরিক্ত ২০%শুল্ক) চেয়েও বেশি ফলে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে অন্য কোন দেশের প্রতিষ্ঠানকে দিতে পারে বলে ধারণা তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের। ফলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে প্রতিযোগিতায় বেশ পিছিয়ে যাবে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে সচল পোশাক কারখানা আড়াই হাজারের মতো। যার মধ্যে বিজিএমইএ’র সদস্য এক হাজার ৩২২টি পোশাক কারখানার ওপর বাড়তি শুল্কের সরাসরি প্রভাব পড়বে। শুল্ক কার্যকর হলে আমেরিকার বাজারনির্ভর বেশিরভাগ দেশীয় পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা। এছাড়া, কর্মসংস্থান হারাবে ১০ লাখের বেশি মানুষ।
চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ থাকলেও তারা আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, ভারতও সমঝোতায় গেছে। ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। তাদের ওপর যে শুল্ক ছিল, সেটা অর্ধেক থেকেও কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক নিয়ে গত তিন মাসে যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর কোনো ফল আসেনি, বেশি দূর অগ্রগতি নেই, শুল্ক কমাতে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কের পরিমাণ ছিলো ৩৭%, ইউনূস সরকার শেষ সময়ে এসে মাত্র দুই শতাংশই কমাতে পেরেছে। মাত্র এই দুই শতাংশ কমানোর পেছনেও ট্রাম্পকে লেখা ইউনূসের চিঠিকে ক্রেডিট হিসেবে দেখছে সরকার, সেক্ষেত্রে যেসব প্রতিনিধিদের সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কচুক্তির আলোচনায় পাঠানো হলো তাদের অযোগ্যতা এবং নেগোসিয়েশনে ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলো আয়োজিত ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার যদি ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে তা রপ্তানি খাতের জন্য ভালো হবে না। (আওয়ামীলীগ পেইজ থেকে।)