জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত “জুলাই গণ-অভ্যুত্থান” উপলক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ২৮ দফার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন, তা ইতোমধ্যেই “জুলাই ঘোষণা” নামে রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ঘোষণাপত্রটি মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিতর্কিত পাঠ তুলে ধরে। এতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার, গণতন্ত্র ও সামাজিক সুবিচারের পুনর্নির্মাণ, এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈধতা দেওয়ার দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
ঘোষণার শুরুতেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করা হয়। এরপর ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালকে একদলীয় বাকশাল হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং ২০০৯–২০২৪ মেয়াদকে “ফ্যাসিবাদী, দুর্নীতিপরায়ণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী শাসনকাল” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংবিধান পরিবর্তন, একদলীয় আধিপত্য, গুম, খুন, অর্থনৈতিক লুটপাট, নির্বাচনী প্রহসনসহ একাধিক অভিযোগ এই পর্বে যুক্ত হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ঘোষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে যে কোটা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন দেশব্যাপী গণবিক্ষোভে রূপ নেয়, এতে প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হন, সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন। ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের ১০৬ অনুচ্ছেদের মতামতের ভিত্তিতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় বলে দাবি করা হয়।
এ ঘোষণাপত্রে ভবিষ্যতের জন্য অবাধ নির্বাচন, গণতান্ত্রিক সংস্কার, আইনের শাসন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং আন্দোলনকারীদের জন্য আইনি সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রস্তাব রাখা হয়েছে এই ঘোষণাপত্র ভবিষ্যৎ সংবিধানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার।
তবে এই ঘোষণাপত্র নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী ও বিশ্লেষক ডেভিড বার্গম্যান। তার মতে, ঘোষণাপত্রটি অতিমাত্রায় একপাক্ষিক ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। এটি যেন একটি বিরোধী দলের রাজনৈতিক ইশতেহার, যেখানে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের বিরোধিতা মুখ্য হয়ে উঠেছে। বার্গম্যান দাবি করেন, এতে ইতিহাসকে একতরফাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—পুরনো একমুখী বয়ানের বদলে আরেকটি বিপরীতমুখী পক্ষপাতদুষ্ট বয়ান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এতে কয়েকটি গুরুতর ঐতিহাসিক অপূর্ণতা ও বিকৃতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের কোনো উল্লেখ নেই। একইভাবে, ২০০৭ সালের ১/১১ ঘটনার অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন সামরিক পটভূমিকে খুবই হালকাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচন, যা দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন ছিল, তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনকালকে সম্পূর্ণ নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হলেও, বাস্তবে এই সময়েই বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল অগ্রগতি এবং জলবায়ু বিষয়ে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্জনও ছিল, যা ঘোষণাপত্রে একেবারে উপেক্ষিত। বার্গম্যান আরো প্রশ্ন তোলেন, সুপ্রিম কোর্টের যে “মতামত”-এর ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি করা হয়েছে, সেটির কোনো স্বাক্ষরিত কপি এখনো প্রকাশ্যে আসেনি—যা ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে।
আরও একটি গুরুতর উদ্বেগ তিনি তুলেছেন “আইনি সুরক্ষা” সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে। তার প্রশ্ন, এটি কি আন্দোলনের সময় সংঘটিত সহিংসতা, এমনকি আওয়ামী লীগ কর্মী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের দায়মুক্তি দিচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে ঘোষণাপত্রে যে “আইনের শাসন” প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা স্ববিরোধী হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে আলোচিত সমালোচনা এসেছে ঘোষণাপত্রকে ভবিষ্যৎ সংবিধানে সন্নিবেশ করার প্রস্তাব নিয়ে। বার্গম্যান বলেন, এত স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন করা একটি দলীয় ও বিতর্কিত দলিলকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক নজির।
তবে বার্গম্যান স্বীকার করেন, কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন—মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, জনগণের কিছু বাস্তব চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে এবং নিহতের সংখ্যা “প্রায় এক হাজার” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা অতিরঞ্জন নয়।
তবে সব কিছুর শেষে তার সবচেয়ে বিস্ময়ের জায়গা হলো—নির্দলীয় পরিচয়ে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস কীভাবে এমন একতরফা ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ঘোষণাপত্রে নিজের নাম জুড়ে দিতে রাজি হলেন? বার্গম্যানের ভাষায়, এটি ড. ইউনূসের নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তিকে চূড়ান্তভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বার্গম্যানের মতে, এই ঘোষণাপত্র যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক সংস্কারের রূপরেখা হয়ে উঠতে চায়, তাহলে সেটিকে আরও সংক্ষিপ্ত, ভারসাম্যপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হতো। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ভিত্তি করে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ রূপরেখায় ফোকাস করলেই এটি হতে পারত একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য দলিল।
জুলাই ঘোষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল। এটি নিয়ে ভবিষ্যতেও আলোচনা হবে, বিতর্ক হবে। এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে, এটি ইতিহাসের পাঠ হবে, নাকি প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার—তা নির্ধারণ করবে সময়, বাস্তবতা এবং জনগণের সম্মিলিত বিবেক।