।।মৃণ্ময় সেন।।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনীয় নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) ও অস্ত্র ক্রয় চুক্তি, গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব-কে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়” এই নীতির ওপর ভিত্তি করেছিল, যা এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো—ভারত, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ভূটান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার কৌশল ছিল।
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে যখন ভারত নিজের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সজাগ ভূমিকা গ্রহণ করছে, তখন বাংলাদেশের একটি অস্থায়ী ও অনির্বাচিত সরকারের পদক্ষেপ অত্যন্ত নিন্দনীয় ও চিন্তার কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও বিমান ক্রয় চুক্তি বাতিল করে তার দেশাত্ববোধ ও জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য প্রমাণ করেছে, যা তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির একটি শক্তিশালী সংকেত। এর বিপরীতে, বাংলাদেশ একটি গোপনীয় নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) স্বাক্ষর করে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, যা দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি বাতিল করে নিজের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বজায় রাখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানির পরিমান প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবুও মার্কিন শুল্ক নীতিতে ভীত না হয়ে ভারত তার জাতীয় স্বার্থ বজায় রেখেছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অবস্থা এর বিপরীত—একটি অস্থায়ী সরকার বছরে ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি রক্ষার লোভে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কীভাবে গৃহীত হলো, তা জনগণের জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, যা সরকারের অযোগ্যতার প্রমাণ।
এর আগেও আমরা দেখেছি “মানবিক করিডোর” এর নামে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে। যদিও অনেক সমালোচানার কারনে সেই প্রকল্প থেকে সরে এসেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ড ইউনুস। কিন্তু আবারও জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করা এক এনডিএ স্বাক্ষর করে এসেছেন তারাই।
এই চুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়া থেকে সস্তা অস্ত্র কেনার পথ ত্যাগ করে ৫-৬ গুণ বেশি দামে মার্কিন অস্ত্র ক্রয়ে বাধ্য হবে। এর সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের চুক্তি যোগ হয়েছে, যা দেশের নিরাপত্তা সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নষ্ট করার আশংকা প্রকাশ করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। আরও হতভম্বকর ব্যাপার হলো, এই চুক্তি নির্বাচিত সরকারের দীর্ঘদিন এড়িয়ে যাওয়া জিসেমিয়া চুক্তিরই পরিবর্তিত রূপ, যা এখন একটি অনির্বাচিত সরকার গোপনে আরোপ করেছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কোনো রাজনৈতিক দল বা জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা না করে এই চুক্তি গ্রহণ করা জাতির প্রতি একটি মহা প্রতারণা।
প্রশ্ন হলো, কেন এই অনির্বাচিত সরকার এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করলো?
প্রথমত, অর্থনৈতিক চাপ ও রপ্তানি বাজারের নির্ভরতা এর পেছনে একটি প্রধান কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক হার কমানোর (৩৫% থেকে ২০%) লোভে বাংলাদেশ এই ছাড় দিয়েছে, যা অর্থনৈতিক স্বার্থকে জাতীয় স্বাধীনতার ওপর প্রাধান্য দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ভূ-রাজনৈতিক চাপে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চীন-ভারত প্রভাব থেকে দূরে রাখতে চায়, এবং এই সরকার সেই চাপের কাছে নত হয়েছে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দুর্বলতা ও আন্তর্জাতিক বৈধতা লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন খুঁজে এই চুক্তি গ্রহণ করা হয়েছে, যা জনগণের সম্মতি ব্যতীত একটি একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত।
এই সব কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয় স্বার্থের অবহেলা। “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়” নীতি পরিত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রের কোলে গিয়ে বসা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতার পরিচায়ক। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জলাঞ্জলি দিয়ে একটি মহাশক্তির প্রভাবে আসা উপনিবেশবাদী প্রভাবের এক নতুন রূপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই পদক্ষেপের ফলে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ক্রমশ খারাপ হচ্ছে, যা এশীয় এলাকায় বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে।
এই পদক্ষেপ জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এবং মার্কিন সম্রাজ্যবাদের একটি সাফল্য। ভারত যেভাবে জাতীয়তাবাদের পথে এগোচ্ছে, বাংলাদেশের এই আত্মসমর্পণ তুলনায় একটি লজ্জাজনক পদক্ষেপ। এই চুক্তি দেশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভঙ্গ করেছে এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে ধ্বংস করেছে। জনগণের প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এই অন্যায় সিদ্ধান্ত বাতিল করা সম্ভব নয়, নতুবা বাংলাদেশ একটি নতুন ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলার মুখোমুখি দাঁড়াবে।