১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে যখন সূর্যের আলোয় নতুন আরেকটি দিনের সূচনা হচ্ছিলো, ঠিক তখনই বাংলাদেশের ইতিহাসের আকাশে নেমে এসেছিল সবচেয়ে অন্ধকারতম প্রহর। সেই ভোরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ছায়াতলে পরিচালিত মানবাধিকারবিরোধী এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরা ছিল সেনাবাহিনীর একটি সুসংগঠিত চক্র, যারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নয়, বরং বিদেশি স্বার্থ পূরণের জন্য কাজ করছিল। পশ্চিমাদের কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, তাদেরকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঢাকায় ও দেশের বাইরে অজস্র গোপন বৈঠকে অংশ নিয়েছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল এই খুনিদেরকে মুখস্ত ও বিশ্বাস করানো যে “দেশ বাঁচানোর” জন্য তারা এই জঘন্যতম কাজ করতে যাচ্ছে স্বপ্রণোদিত হয়েই!
এই ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি কিন্তু শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকেই। ১৯৭২ সাল থেকে পশ্চিমা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, নীতি ও অর্জনকে বিকৃত করে প্রচার করা হয়, বিদেশি পত্রপত্রিকা ও সম্প্রচারমাধ্যমে তাকে অযোগ্য ও স্বৈরাচারী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হয়। একই সময়ে দেশে গুজব ছড়ানো হয় – সরকার ভেঙে পড়ছে, অর্থনীতি ধ্বংসের পথে, স্বাধীনতা টিকবে না। পরিকল্পিতভাবে খাদ্য সরবরাহ ও বৈদেশিক সাহায্য আটকে দিয়ে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়, যা সামাজিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে চরমে পৌঁছে দেয়। এই পরিস্থিতি তৈরি করে তারা দেশের ভেতরে বঙ্গবন্ধুবিরোধী অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তুষ্ট কিছু কর্মকর্তাকে ধীরে ধীরে তাদের পরিকল্পনায় টেনে আনে।
বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর যেসব নীতি নিয়েছিলেন—নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা, সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে উন্নয়ন এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান – এসব সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর কৌশলগত স্বার্থের বিপরীতে ছিল। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতসহ স্বাধীনতার পক্ষে থাকা শক্তিগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছিল। বিশেষ করে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন, আফ্রিকার মুক্তিকামী আন্দোলন ও নিরপেক্ষ জোটের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান পশ্চিমাদের চোখে বাংলাদেশকে ‘সম্ভাব্য শত্রু রাষ্ট্রে’ পরিণত করেছিল।
এই অসন্তোষ থেকেই ওয়াশিংটন এবং লন্ডনের কিছু চক্র বঙ্গবন্ধুকে সরানোর নীলনকশা তৈরি করে। মার্কিন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) এবং ব্রিটিশ এমআই৬ স্থানীয় যোগাযোগগুলো ব্যবহার করে খুনি সেনা কর্মকর্তাদের সাহস ও সমর্থন যোগায়। হত্যার আগে অর্থনৈতিক সহায়তা কমিয়ে, বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং আন্তর্জাতিক ঋণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুকে সংকটে ফেলে দেওয়া হয়। পশ্চিমা কূটনীতিকরা ঢাকায় গোপনে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে অজস্র সাক্ষাৎ করেছিল – যা পরবর্তীতে নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ সহ খুনীদের নিজেদের ভাষ্যেই উঠে আসে।
১৫ আগস্টের পরপরই পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া ছিল ঠাণ্ডা ও পরিকল্পিত। যুক্তরাষ্ট্র নতুন ক্ষমতাসীনদের স্বীকৃতি দিতে দেরি করেনি। তাদের রাষ্ট্রদূত দ্রুত নতুন শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করলেন, সামরিক সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিলেন, যেন হত্যাকাণ্ডকে তারা নীরবে বৈধতা দিল। লন্ডন থেকেও একই ধরনের সাড়া এল। এই আচরণ প্রমাণ করে, হত্যার আগে ও পরে—দুই সময়েই পশ্চিমাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, আর তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে আঁকার সুযোগ নিয়েছিল।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে একই গোষ্ঠী আবারও একই কৌশল ব্যবহার করল, তবে চরিত্র বদলালো। এবার তারা সেনাবাহিনীর খুনি অফিসারদের জায়গায় মাঠে নামাল দাঙ্গাবাজদের, যারা প্রথমে ‘ছাত্র আন্দোলন’ নামের আড়াল ব্যবহার করল, পরে তা রূপ নিল অরাজকতা ও সহিংসতায়। কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবিকে তারা পরিকল্পিতভাবে বিকৃত করে দিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া একযোগে এই অস্থিরতাকে সরকারবিরোধী বিদ্রোহ হিসেবে প্রচার করল। মাঠে থাকা দাঙ্গাবাজদের মধ্যে ঢুকে পড়ল নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, যারা পশ্চিমাদের ইশারায় সরকারি অফিস, পুলিশ থানা, আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালাল। এই সহিংসতার প্রতিটি ধাপ বিদেশি স্বার্থের পক্ষে কাজ করল – দেশে আতঙ্ক ছড়ানো, প্রশাসনকে অচল করে দেওয়া, এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে সরকারের ভাবমূর্তি ধ্বংস করা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পড়ে যাওয়ার পর পশ্চিমা মিডিয়া সেটিকে গণঅভ্যুত্থানের সাফল্য হিসেবে প্রচার করল, অথচ এটি ছিল একটি নির্বাচিত সরকারকে পতন করানোর জন্য বিদেশি প্রভাবের সুনির্দিষ্ট নকশা।
দুই ঘটনাতেই মিল অবিশ্বাস্য। ১৯৭৫-এ সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দলকে ব্যবহার করা হয়েছিল, যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ড ঘটায়; ২০২৪-এ ব্যবহার করা হলো দাঙ্গাবাজদের, যারা সন্ত্রাস ও অরাজকতার মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিল। দুই ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মাঠের খেলোয়াড়দের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়েছে – কখনো তা ছিল প্রকৃত অস্ত্র, কখনো তা ছিল প্রচারযন্ত্র, কূটনৈতিক চাপ এবং অর্থনৈতিক প্রলোভন। ১৯৭৫-এর খুনিরা যেমন নিজেদের ‘দেশপ্রেমিক’ দাবি করেছিল, ২০২৪-এর জুলাই দাঙ্গাবাজরাও নিজেদের ‘গণআন্দোলনের সৈনিক’ বলে চালাতে চেয়েছে। কিন্তু উভয়ের পেছনে ছিল একই সুতো – যা টেনে নিয়েছে বিদেশি শক্তি।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ও ৫ আগস্ট ২০২৪ – এ দুটি ঘটনা আলাদা সময়ে ঘটলেও বাস্তবে এটি একই খেলার দুটি অধ্যায়। লক্ষ্য ছিল এবং আছে — ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২-এর সংবিধানকে ধূলিসাৎ করে বাংলাদেশকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের করায়ত্তে নিয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধুর রক্ত ঝরানো সেই কালরাত যেমন ছিল তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য, শেখ হাসিনার পতনও ছিল সেই ষড়যন্ত্রের নতুন সংস্করণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, খেলোয়াড় বদলায়, সময় বদলায়, কিন্তু কুশীলব বদলায় না।(আওয়ামী লীগ পেইজ থেকে)