
।। মাহবুব জামান।।
১৪ আগস্ট ১৯৭৫। সন্ধ্যা৬:৫০ মিনিট।
আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে।
আমি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী গণভবনে গিয়েছি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য।পরের দিন ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন।
প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা জানানোর জন্যই আমাদের আসা।গাড়িতে আমরা কি কি বিষয়ে আলোচনা করবো সেগুলোও ঠিক করেছি।
ঐ দিন সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিছু অস্বাভাবিক ও অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে। সকালে উঠেই শুনি সামসুন্নাহার হলের সামনে রাস্তায় একটি পাকিস্তানি পতাকা উড়ানো দেখা যাচ্ছে।
ঐদিন পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ছিল।
এর কিছুক্ষণ পরই বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর সামনে দুইটা পটকা বিস্ফোরণ হয়। তার কিছুক্ষণ পর খবর পাওয়া যায় সায়েন্স এনেক্স ভবনে একটা বাজারের ব্যাগে বেশ কিছু ককটেল পাওয়া গেছে।
আমরা পুলিশ ও সব গোয়েন্দা সংস্থায় খবর দেই এবং তারাও তৎপর হয়ে উঠে।
আমরা ঠিক করেছিলাম এই বিষয়গুলোও বঙ্গবন্ধুকে জানাবো।
আমাদের মিটিংয়ের সময় ছিল সন্ধ্যা সাতটা। কিন্তু,আমরা পৌছানোর পরপরই হানিফ ভাই, তোফায়েল ভাই সহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ সবাই ছুটে এলেন এবং ভিসি স্যারকে বললেন ” উনি আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন।”
আমরা ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু এগিয়ে এসে বললেন-
“কি প্রফেসর স্যার,খুব কষ্ট হইতাছি,খাটনি যাইতাছে না।আমিও এক্সসাইটেড,অনেক দিন পর ঢাকা ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি। অনেক কথা আছে।”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,” কি ছোট নেতা, মুখ শুকনা ক্যান? ঝামেলা? কালকে আমি নতুন দিনের ডাক দিব “।
ভিসি স্যার বললেন, ” না, মানে আজ সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়……..
“হ্যাঁ ,হ্যাঁ আমি সব জানি।পাকিস্তানি পতাকা, বোমা,পটকা- এ সব দিয়ে কিচ্ছু হবে না।কাল থেকে শুরু হবে নতুন জীবন।”- থামিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন।
আমরা আগামীকালের সব কর্মসূচি জানালাম।
চা-নাস্তা আসলো।উনি সব শুনে বললেন-ঠিক আছে, আমি কার্জন হলে নামবো, ফজলুল হক হলের ক্যান্টিনে একটু নামবো।ওখানে ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। মধুর ক্যান্টিনে যেতে দিল না সিকিউরিটি।তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বেশ কিছু স্মৃতির কথা বললেন।অনেকক্ষণ।
হঠাৎ উঠে গিয়ে দেয়াল টানানো ছবিগুলো দেখানো শুরু করলেন।সাথে বর্ননা।
ফিডেল ক্যাস্ট্রো, যোসেফ ব্রজ টিটো, ব্রেজনেভ, রাশিয়া ,চীন,ইন্দিরা গান্ধী-অনেক অনেক।
এই পুরো সময়টাতে আর একজন মাত্র মানুষ ছিল।তার নাম খন্দকার মোশতাক।সারাক্ষণ একটি কথাও বলেন নি।
প্রায় বিদায়ের মুহুর্তে বললেন,” মুজিব ভাই, আমি কিন্তু কাল যাচ্ছি না। একটু দশপাড়া যামু।”
সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু বললেন,” চোরা, এইটা আবার তোর কি চোরা বুদ্ধি। কালকে নতুন ডিক্লারেশন দিব। শুরু হবে নতুন দিন”।
না,মানে বাড়িতে আপনার জন্য কিছু তিন শনি কৈ মাছ ধরে রাখছে।ওগুলো নিয়ে আসবো।সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবো। চিন্তা কইরেন না।
“কৈ মাছ আনতে তোর যাইতে হবে? যত সব চোরা বুদ্ধি।”
সেটাই ছিল গণ ভবনে বঙ্গবন্ধুর শেষ সাক্ষাৎ। এর পর ৩২ নম্বরে চলে গেলেন-বললেন কয়েকজন সিনিয়র নেতা আসবেন।আমরা ফিরে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এরপর এক অন্ধকার ইতিহাস……….
৫০ বছর পর ঐ সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে।এর পর দিন থেকে ঠিকই নতুন দিন শুরু হয়েছিল। সেটা খন্দকার মোশতাকদের দিন।
বঙ্গবন্ধুর মত এমন মহামানব,জাতির জনকের সাথে শেষ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখা হয়েছে-এটা ভাবতেও অবাক লাগে। আমরা কত শতবার তাঁর সাথে দেখা করেছি হিসাব দিতে পারবো না।
বঙ্গবন্ধুকে আমি কখনও শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে দেখিনি। উনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ।স্নেহ,ভালোবাসা,মমতা,মানবতা,দৃঢ়, কঠোর,সুখ- দু:খ,আনন্-বেদনা-সব মিলিয়েই তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
বঙ্গবন্ধুকে এত কাছ থেকে দেখার ও কাজ করার সুযোগ কোনো দিনই হোত না,যদি আমি ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত না হতাম।
১৯৭২ এর মে মাসে আমরা ছাত্র লীগকে পরাজিত করে ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ করি।শুধু ডাকসু নয়,দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে তখন ছাত্র ইউনিয়ন-এর জয় জয়কার।
এই বিপুল বিজয়ের পর আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই, উনি উচ্ছ্বসিত। সবাইকে মিষ্টিমুখ করালেন।গণ ভবনের সবাইকে ডেকে বললেন ‘গণ ভবণের দরজা এদের জন্য উন্মুক্ত’। আর আমাদের বললেন,’তোরা যে কোন সময় আমার কাছে চলে আসবি।’
এই কথা যে এত সত্যি ছিল, কল্পনাও করিনি।পরবর্তীকালে বণ্যার সময়, দুর্ভিক্ষের সময়, শিক্ষা নীতি প্রনয়নের সময় আমরা প্রায় প্রতিদিন দেখা করেছি।কোন কোন সময় দিনে একাধিকবারও দেখা করেছি।
আমরা তাঁকে দেখেছি খাবার টেবিলে, এরিনমোর তামাক ও পাইপ হাতে সাদা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায়,দেখেছি গণভবনের অফিস কক্ষে। আমরা তাঁর রাগ দেখেছি, অভিমান দেখেছি, আদর দেখেছি,মমতা দেখেছি।
একেই বলে প্রকৃত নেতা,পূর্ণাঙ্গ মানুষ,জাতির জনক।
এই বঙ্গবন্ধুর শেষ সন্ধ্যাটা আমরা পেয়েছিলাম,এ আমার পরম সৌভাগ্য। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নাই। উনি বেঁচে থাকবেন আমাদের জীবনে চিরকাল। জয় বাংলা !!!