তিন বছরের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্যের হার ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে, অতিদারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক জরিপে দারিদ্র্য বৃদ্ধির এই চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আর অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
‘২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশের পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল সোমবার প্রকাশ করে পিপিআরসি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান গবেষণার ফল তুলে ধরেন। গবেষণা দলের নেতৃত্বও দেন তিনি। পিপিআরসির জরিপে দারিদ্র্যের বাইরে কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সূচকের অবনতির চিত্র উঠে এসেছে।
গত ৮ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ে সারাদেশের আট হাজার ৬৭টি খানা বা পরিবারের ওপর পিপিআরসির জরিপ পরিচালিত হয়। এসব খানার সদস্য ৩৩ হাজার ২০৭ জন। সারাদেশে নারী-পুরুষ, গ্রাম-শহর, বয়স ও পেশার ভিন্নতা বিবেচনায় জরিপে অংশকারীদের নির্বাচন করা হয়।
অনুষ্ঠানে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে তিন ধরনের সংকটের প্রভাব চলমান। এগুলো হলো– কভিড, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। কভিডের কারণে কিছু সমস্যা অবশ্য অনেক দেশেই আছে।
তিনি বলেন, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়তে মানুষের জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সে বিবেচনা থেকেই নীতি পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। প্রায়ই বিভিন্ন আলোচনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা বলা হয়। তবে জনগণের হয়রানির কথা বলা হয় না। অথচ হয়রানির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতির পরিকল্পনায় জনমুখী দৃষ্টি থাকা খুবই জরুরি।
হোসেন জিল্লুর বলেন, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বেকারত্বের এক মহাদুর্যোগের বাস্তবতার মধ্যে দেশ রয়েছে। এ বাস্তবতায় কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের চিন্তা করতে হবে। শুধু জিডিপির ওপর আলোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে সমতা, ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা ও নাগরিকের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে। অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও ব্যষ্টিক অর্থনীতির তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
১৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে
পিআরসির গবেষণা বলছে, ১৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তিন বছরের ব্যবধানে শহরের পরিবারের মাসিক আয় কমেছে। কিন্তু খরচ বেড়ে গেছে। শহরের একটি পরিবারের গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা। খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। বিবিএসের জরিপে ২০২২ সালে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। অন্যদিকে গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। গ্রামের একটি পরিবারের গড় আয় ২৯ হাজার ২০৫ টাকা। খরচ ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। বিবিএসের জরিপে ২০২২ সালে গ্রামের পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। জাতীয়ভাবে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। খরচ হয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। সঞ্চয় নেই বললেই চলে। নিচের দিকের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আয়ের মানুষের তুলনায় ব্যয়ের হার বেশি বেড়েছে।
কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মরত হিসাবে বিবেচিত ৩৮ শতাংশ মানুষ প্রকৃতপক্ষে আংশিক বেকার। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করেন তারা। ১৮ বছরের বেশি বয়সের সদস্য যারা সপ্তাহে কমপক্ষে এক ঘণ্টা কাজ করেছে এ রকম পরিবার আছে ৫২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার মাত্র ২৬ শতাংশ, যা উদ্বেগের বিষয়। কর্মসংস্থানের ধরনে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বড় অংশ হলো স্বনিয়োজিত, যা প্রায় ৪৫ শতাংশ। এসব তথ্য প্রমাণ করছে, কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের ভাবনা এবং জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন।
ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে
পিপিআরসির প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্যের পেছনে পরিবারপ্রতি মোট ব্যয়ের ৪৯ দশমিক ৯ শতাংশ খাদ্য কিনতে লাগে। গ্রামে এ হার বেশি। মোট ব্যয়ের ৫৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। শহরে এ হার ৪৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় অতিদরিদ্র ১২ শতাংশ পরিবার জরিপের আগের সপ্তাহে কোনো না কোনো বেলা খাদ্য গ্রহণ বাদ দিয়েছে। ৮ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারে জরিপের এক মাস আগে কোনো কোনো সময় পুরো দিন খাবার ছাড়াই কেটেছে। মানুষের প্রধান উদ্বেগ পণ্যের দাম বৃদ্ধি, আয় কমে যাওয়া, চিকিৎসা ব্যয়, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা এবং আগামী দিনের ব্যয়। সামাজিক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে– রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্কোন্দল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মাদকাসক্তি ইত্যাদি।
পুলিশ আর রাজনীতিকদের ঘুষ-চাঁদাবাজি বেড়েছে
পিপিআরসির গবেষণায় বলা হয়, গত বছরের আগস্টের পর পুলিশ ও রাজনীতিকদের ঘুষ ও চাঁদাবাজি বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে কমেছে জরিপে অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ বলেছেন, তারা গত বছরের আগস্টের আগে সেবা নিতে ঘুষ দিয়েছেন। আগস্ট মাসের পর এই হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমেছে। উত্তরদাতাদের ৩১ দশমিক ৭৭ বলেছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে পুলিশকে ঘুষ দিতে হতো। এ হার ৫ আগস্টের পরে বেড়ে ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়েছে। একইভাবে রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ বা চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন ৩৩ শতাংশ উত্তরদাতা। ৫ আগস্টের আগে এ পরিস্থিতির কথা বলেছেন ২৫ শতাংশ উত্তরদাতা। এ প্রসঙ্গে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ঘুষ ও চাঁদা দেওয়ার কথা সাধারণত মানুষ বলতে চান না। এ কারণে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। বাস্তবে এ হার আরও বেশি ।
আগামীর পাঁচ ঝুঁকি
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় পাঁচটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। প্রথমত, দীর্ঘস্থায়ী রোগব্যাধিতে ব্যয়ের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, নারীপ্রধান পরিবারগুলো সমাজের সবচেয়ে নিচের স্তরে পড়ে আছে। তাই এদের বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ঋণের বোঝা বাড়ছে, যা একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে। চতুর্থত, ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। এটি এখনও ব্যাপক আকারে হয়নি, তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং এটি উদ্বেগজনক। পঞ্চমত, স্যানিটেশন সংকট। এসডিজি অর্জনে হাতে মাত্র পাঁচ বছর আছে; কিন্তু এখনও প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ নন-স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করছে। ফলে নিরাপদ স্যানিটেশন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় একটি নতুন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করেন তিনি।