।। রুচিরা সুলতানা।।
খুব দারুন একজন মানুষের গল্প বলবো। যিনি বই পড়তে গিয়ে, বাম চোখে এক পৃষ্ঠা আর ডান চোখ দিয়ে অন্য পৃষ্ঠা একসাথে পড়তে পারতেন। যিনি ৮-১০ সেকেন্ডের মধ্যে একজোড়া পৃষ্ঠা পড়া শেষ করে ফেলতে পারতেন। যিনি একবার পড়েই পুরো বই মুখস্ত করে ফেলতে পারতেন। তিনি কিম পিক, যিনি তার নিজের জীবনে প্রমাণ করেছেন,” মানসিক ভিন্নতা কোন অভিশাপ নয় বরং ভিন্ন ধরনের একটা শক্তি।”
“We are all different. You don’t have to be disabled to be different.”
__এটি
১৯৫১ সালে আমেরিকার সল্ট লেক সিটিতে জন্ম নেওয়া, কিম পিক (Laurence Keem Peek) এর কথা এটা।
কিমের জন্মের পরপরই ডাক্তাররা ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে, সে কখনো হাটতে পারবে না। শুধু তাই নয় , মস্তিষ্ক অস্বাভাবিকতার কারনে সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নিতে পারবে না। কিমের মস্তিষ্কের cerebellum আংশিক গঠিত, সেই সাথে তার ‘corpus callosum’ নেই।
এদিকে কিমের জন্মের পর পরই তার বাবা এবং মায়ের বিচ্ছেদ হয়। কিম তার বাবার কাছে বড় হচ্ছিলো ।
কিমের বাবা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছেলেকে তিনি যেভাবেই হোক মানুষের মত মানুষ করবেন।
স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ থাকায়, কিমের বাবা তাকে বাড়িতে পড়ানো শুরু করেন।
আশ্চর্যজনকভাবে তিন বছর বয়স থেকেই কিম পড়তে শুরু করে।বড় হওয়ার সাথে সাথে তার বিস্ময়কর এক ক্ষমতা দেখতে পেলো সবাই।কিম একসাথে দুটি চোখ দিয়ে, দুটি আলাদা পৃষ্ঠা পড়তে পারতো এবং যা পড়তো তার ৯৮% মনে রাখতে পারতো। ডাক্তারদের ভবিষ্যৎবাণী ভুল প্রমাণ হলো । কিম হয়ে উঠলো ,জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া।
কিম তার জীবনে প্রায় বারো হাজার বই মুখস্ত করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল বাইবেল, শেক্সপিয়ারের নাটক, ফোন ডিরেক্টরি,এরিয়া কোড,ইতিহাস, গণিত, সংগীত, সাহিত্য ইত্যাদির উপর লিখিত সব ধরনের বই।
একবার একজন অধ্যাপক তাকে ‘হ্যামলেট’ নাটকের একটি দীর্ঘ অংশ পড়ে শোনালেন। কিম সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
“Act ll, scene ll, line 211”
অধ্যাপক বই মিলিয়ে দেখার পর, যার পর নাই বিস্মিত হলেন। কিমের উত্তর পুরোপুরি সঠিক ছিল। শেক্সপিয়ারের প্রতিটি নাটক তিনি শুধু মুখস্ত জানতেন তাই না বরং লাইন ,নম্বর পর্যন্ত হুবহু মনে রাখতে পারতেন।
কিম পিক বেশিরভাগ সময়ই লেখাপড়া করতেন, সল্ট লেক সিটি পাবলিক লাইব্রেরীতে। সেখানে তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের বই পড়তেন, এবং পড়া শেষ হলে উল্টো করে রেখে দিতেন। যেন বুঝিয়ে দিতে পারেন যে ,তিনি সেগুলো ইতিমধ্যে মুখস্থ করে ফেলেছেন।
এরকমই একদিনের কথা, লাইব্রেরীতে কিম পড়ছিলেন। একজন সাংবাদিক তাকে পরীক্ষায় ফেলতে চাইলেন। তার উল্টো করে রাখা বইগুলোর একটি থেকে মাঝখানের কয়েকটি লাইন পড়ে শোনালেন। কিম বই বন্ধ করে শুনে বললেন,
__”That’s page 232, right side, third paragraph .”
দেখা গেল, কিমের উত্তর একদম সঠিক।
কিমের ছিল অসাধারণ এক ক্যালেন্ডার ক্যালকুলেশন ক্ষমতা। যেকোনো তারিখ দিলেই তিনি তাৎক্ষণিক বলে দিতেন সেটা সপ্তাহের কোন দিন।
বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন, কিম প্রায় ১০,০০০ বছরের ক্যালেন্ডার (অতীত ও ভবিষ্যৎ) মাথায় ধারন করতে পারেন।
NASA একবার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা পরীক্ষার জন্য। সেখানে বিজ্ঞানীরা তাঁর মস্তিষ্ক স্ক্যান করে নিশ্চিত হন– তার corpus callosum নেই।
মানুষের মস্তিষ্ক সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা।বাম মস্তিষ্ক আর ডান মস্তিষ্ক। এই দুই ভাগকে corpus callosum নামের একটি মোটা স্নায়ু সেতু যুক্ত করে রাখে। এর মাধ্যমে ডান এবং বাম পাশের মস্তিষ্ক একে অপরের সাথে তথ্য আদান প্রদান করে। এটা যদি কারো মস্তিষ্কে না থাকে, তাহলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমে যায়। কিম পিকের জন্মগতভাবে corpus callosum ছিল না । তবে এই সমস্যা তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠে, দুই পাশের মস্তিষ্ক একইসময়ে আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করতে সক্ষম।
আর cerebellum এর মাধ্যমে মানুষের শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য, নড়াচড়া ,হাঁটা, দৌড়ানো এইসব কাজ নিয়ন্ত্রণ হয়। সেটি আংশিকভাবে গঠিত হবার কারণে,কিম দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাট কাজ করতে পারতেন না। যেমন, নিজে কাপড় পরা, খাবার বানানো, টাকা ব্যবহার করা ইত্যাদি।
বাবার হাত ধরেই তিনি পৃথিবীজুড়ে বক্তৃতা এবং প্রদর্শনীগুলোতে অংশ নিয়েছেন।বাবা ফ্রান পিক সারাজীবন তার যত্ন নিয়েছেন।
৫৮ বছর বয়সে কিম মৃত্যুবরণ করেন, এবং তার আগ পর্যন্ত প্রায় ৬০মিলিয়ন মানুষের সামনে নিজের অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন, মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
মৃত্যুর পরও তার মস্তিষ্ক গবেষণার জন্য রেখে দেয়া হয়েছে।
১৯৮৮ সালে নির্মিত বিখ্যাত “Rain Man” ছবিটি তার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছিল।
কিম পিকের জীবন আমাদের সামনে একটা অনন্য দৃষ্টান্ত। যা প্রমাণ করে, অক্ষমতা কখনো কখনো সক্ষমতার চাইতেও বেশী কিছু হয়ে উঠতে পারে।