বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে ইউনূস সরকারের দুর্নীতি-অনিয়ম এবং নিম্নমানের প্রকাশনার পর এবার কাজ পাবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান, ধসের মুখে দেশিয় শিল্প
❐ বিশেষ প্রতিবেদক
বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণকে ঘিরে দীর্ঘদিনের বিতর্কের পর এবার আন্তর্জাতিক দরপত্রের পথে হাঁটল অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে দেশিয় প্রেস মালিকদের দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও, বিপরীতে একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পখাত ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ইউনূস সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণের আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮-এর ৮৩(১)(ক) ধারা সংশোধন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। সংশোধনের ফলে দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা ৪২ দিন থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে ১৫ দিনে।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ের বইয়ের জন্য ইতোমধ্যে ১৯০ লটের দরপত্র অনুমোদন হয়ে গেছে। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ের ২১ কোটি বইয়ের প্রস্তাব গত ১৯শে আগস্ট ক্রয় কমিটি ফেরত দিয়েছে। সেই সিদ্ধান্তের পরই আন্তর্জাতিক দরপত্রের উদ্যোগ নেওয়া হলো।
উল্লেখ্য, দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি এবং নিম্নমানের প্রকাশনার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বেশ কয়েক বছর শিশুদের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের দায়িত্ব পেয়েছিল ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিক দরপত্রে সর্বনিম্ন দর এবং মান-যাচাইপূর্বক কাজ পেয়েছিল ভারতীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, যারা যথাসময়ে চাহিদা মোতাবেক বই সরবরাহ করতে সমর্থ হয়েছিল বলে সুনাম অর্জন করে।
কিন্তু ইউনূস সরকার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে অনীহা প্রকাশ করে প্রকাশনার দায়িত্ব দেয় দেশিয় প্রতিষ্ঠানকে। এতে পূর্বের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অথচ যথাসময়ে বই প্রাপ্তি দূরে থাক, ছাপায় নিম্নমানের কাগজ ও কালি, তদারকিতে অবহেলা, বই ছাপার আগে সংশ্লিষ্ট প্রেসে গাইড বই ছাপা, বিনামূল্যের বই বাজারে বইয়ের দোকানে ছেড়ে দেওয়া, প্রকাশনার দায়িত্বশীলদের শত শত কোটি টাকার অনিয়মসহ নানা দুর্নীতি প্রকাশ্যে চলে আসে।
এমনকি বইয়ের মান যাচাইয়ে দায়িত্ব পাওয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফরাসি প্রতিষ্ঠান ব্যুরো ভেরিতাসের কর্মকর্তাদেরও আর্থিক অনিয়ম দুর্নীতি জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ক্রয় ও অর্থনৈতিক অধিশাখার উপসচিব মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, বই মুদ্রণ একটি জরুরি কাজ। তাই সময়সীমা কমানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন—যেভাবে বিধিতে বলা আছে, দরপত্র সেভাবেই আহ্বান করা হবে।
দেশিয় শিল্পের আশঙ্কা
এদিকে, প্রেস মালিকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে দেশিয় শিল্প ধসে পড়বে। বর্তমানে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত। কাগজ, কালি, মেশিনারি, বাইন্ডিং, প্যাকেজিং ও পরিবহনসহ প্রতিটি ধাপেই কর্মসংস্থান রয়েছে কয়েক লাখ মানুষের।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের এক্সপোর্ট অ্যান্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “পাঠ্যপুস্তক ছাপার মতো কাজ বিদেশিদের হাতে দিলে এটি সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। এ শিল্পে পেপার মিল মালিকদের বিনিয়োগই প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। প্রেস মালিকদের বিনিয়োগ আরও ২০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক দরপত্র হলে লাখো মানুষ বেকার হয়ে যাবে।”
দেশিয় প্রেস মালিকরা জানাচ্ছেন, তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা কাঁচামালের দাম। স্থানীয়ভাবে এক টন কাগজ কিনতে হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায়, যেখানে চীনে একই মানের কাগজের দাম ৭৭ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ভর্তুকি যোগ হলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই কম দরে বই মুদ্রণের প্রস্তাব দিতে পারবে। স্থানীয় প্রেস যেখানে প্রতি ফর্মায় রেট দেয় ৩ টাকা ১৫ পয়সা, সেখানে চীন তা দিতে পারবে মাত্র ২ টাকা ২০ পয়সায়। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
বিতর্ক ও অভিযোগ
এনসিটিবির কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশিয় প্রেস মালিকরা বারবার দরপত্রে ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লোকসান ঘটিয়েছে। চলতি বছরই রাষ্ট্রের ৩২৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে তাদের সমঝোতার কারণে। একইসঙ্গে নিম্নমানের বই সরবরাহের ঘটনাও ঘটেছে বারবার। এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশি ইন্সপেকশন এজেন্টদের বিরুদ্ধেও আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের বইকে ‘ভালো’ বলে অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
প্রসঙ্গত, এ বছরও একাধিক প্রেস মালিক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিপুল লটের বইয়ের কাজ পেয়েছেন বলে ক্রয় কমিটিতে অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যেই নতুন দরপত্র বাতিল ও আন্তর্জাতিক টেন্ডারের সিদ্ধান্ত আসে।
প্রেস মালিকদের দাবি, প্রিন্টিং ও প্রকাশনা কাজ স্থানীয় শিল্প সংরক্ষণের তালিকায় রয়েছে। পিপিআর ২০০৬ এবং ২০০৮ অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তা, প্রশ্নপত্র, সরকারি প্রকাশনা কিংবা সিকিউরিটি পেপার বিদেশিদের কাছে দেওয়া যায় না। তাই আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করাই আইনের লঙ্ঘন।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
এনসিটিবির কর্মকর্তারা মনে করছেন, এখন নতুন দরপত্র আহ্বান করা হলে জানুয়ারির মধ্যে বই পৌঁছে দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সরকার সময়সীমা কমালেও মূল্যায়ন, অনুমোদন ও মুদ্রণের ধাপ দ্রুত সম্পন্ন করা না গেলে শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই পৌঁছানো কঠিন হবে।
পড়ুন: ছাপাখানার সাথে গোপন আঁতাতে শিশুরা পেল ৮ কোটি নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক
অধ্যাপক রিয়াদ চৌধুরী, এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক), বলেন, “আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হলো ১লা জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেই অনুযায়ী দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করব।”
ইউনূস সরকারের আন্তর্জাতিক দরপত্রের সিদ্ধান্তে আপাতত বইয়ের মান নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও, এর ফলে দেশিয় মুদ্রণ শিল্পে ধস নামতে পারে—এমন আশঙ্কা স্পষ্ট। একদিকে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়ছে, অন্যদিকে আইনি ও নীতিগত বিতর্কও সামনে আসছে। ফলে পাঠ্যবই ছাপার বিষয়টি শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এখন জাতীয় অর্থনীতি ও নীতির প্রশ্নেও রূপ নিচ্ছে।