শিক্ষাক্ষেত্রের চরম বেহাল দশা হয়েছে গত এক বছরে। একদিকে শিক্ষকরা বেতন-ভাতা ও জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে, অন্যদিকে ছাত্ররা ক্লাস ছেড়ে রাজপথে। যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার মান ও পরিবেশে। পাঠশালায় নয়, শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হয়েছে রাজপথে। নানা দাবিতে প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব আন্দোলনের মূল দাবির বাইরে গিয়ে তারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
এমনকি গুপ্ত সংগঠন জামায়াত শিবির-এনসিপির পক্ষে নিয়ে অনেক ছাত্র জাতীয় স্বার্থ, মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতি ও সংস্কৃতিবিরোধী কাজেও যুক্ত হয়ে পড়েছে। তারা নানা বয়ান সামনে আনছে নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে বিপাকে পড়েছেন। তাদেরকে বহিষ্কারসহ মব লেলিয়ে ভয় ভীতি দেখিয়ে ক্যাম্পাসে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। ছাত্ররা রাজনৈতিক দাবির পাশাপাশি আবাসন সংকট, অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবহন সুবিধা, এমনকি ‘প্রকৌশলী’ পদবী সংক্রান্ত দাবিতেও রাস্তায় নামছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো জায়গায় ভিসিকে অবরুদ্ধ করা, প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়া এসব ঘটনাও নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের রোডম্যাপ ও বৃত্তির দাবিতে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন এবং প্রায় আট ঘণ্টা ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। একই সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে, ফলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
শিক্ষকদের অবস্থাও ভালো নয়। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষকরা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে ব্যস্ত। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকরা আলটিমেটাম দিয়েছেন। দাবি মানা না হলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছেন তারা। এর ফলে পাঠদানে প্রভাব পড়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বেতন স্কেল উন্নীতকরণের দাবিতে ৩০শে আগস্ট ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসাররাও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে তাদের গ্রেড উন্নীত না হওয়ায় তারাও অসন্তুষ্ট।
এই অস্থিরতায় শিক্ষার মূল ভিত্তি পাঠদান চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের মনোযোগ নেই, শিক্ষার্থীরাও বইয়ের টেবিল থেকে সরে গিয়ে আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড হাতে নিচ্ছে। স্কুল-কলেজে সুশৃঙ্খল শিক্ষার পরিবেশ নেই বললেই চলে। পাঠ্যপুস্তকের অভাব, শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরতা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তুলছে। সর্বোপরি পড়াশোনা উঠেছে লাটে!
এদিকে বই ছাপা নিয়েও তৈরি হয়েছে বড় সংকট। চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই পেতে মার্চ-এপ্রিল পেরিয়ে যায়। আগামী বছরের জন্যও পাঠ্যবই যথাসময়ে ছাপা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের আরও পিছিয়ে দেবে।
শিক্ষা প্রশাসনের দুর্বলতাও এই সংকটকে ঘনীভূত করছে। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী সম্প্রতি এক সংলাপে বলেন, ‘শিক্ষাকে অগ্রাধিকারের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষায় শুধু পুনর্গঠন নয়, রূপান্তর প্রয়োজন। শিক্ষার্থীকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে শুধু পরীক্ষার্থী নয়।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্ররা যেমন শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে রাজপথে সময় কাটাচ্ছে, তেমনি শিক্ষক ও প্রশাসনের দায়িত্বহীনতাও এই চিত্রকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। ফলাফল শিক্ষাব্যবস্থা আজ নীতিহীনতা, দুর্বলতা ও চরম অস্থিরতায় নিমজ্জিত বলে মনে করছেন সুধীজন।