ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদনকারী ছাত্রীকে ‘গণধর্ষণের’ হুমকি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সোমবার ডাকসু নির্বাচন স্থগিতের আদেশ দেওয়ার পর আলী হোসেন নামের ওই শিক্ষার্থী ফেসবুকে তাঁকে ‘গণধর্ষণের’ হুমকি দিয়ে পোস্ট করেন।
আলী হোসেনের এমন পোস্টের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থী ও অনেকে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ছাত্রশিবিরের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদও এ ঘটনায় আলী হোসেনের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
ওই ছাত্রী বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠন–সমর্থিত ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ প্যানেল থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ওই শিক্ষার্থী দুপুরে মধুর ক্যানটিনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এই রিট আবেদন করার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, এস এম ফরহাদের অবস্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, ফরহাদ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তাঁর পদত্যাগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই ফরহাদের কর্মকাণ্ড ডাকসুর গঠনতন্ত্রের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’ বলে মনে করেন তিনি।
তাঁকে হুমকি দেওয়া শিক্ষার্থী আলী হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। আলী হোসেন তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘হাইকোর্টের বিপক্ষে এখন আন্দোলন না করে আগে একে গণধর্ষণের পদযাত্রা করা উচিত।’
তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন ডাকসু নির্বাচনে ভিপি প্রার্থী ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক আব্দুল কাদের। তিনি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘রিটকারী নারী প্রার্থীকে লিগ্যালি এবং পলিটিক্যালি ডিল না করে তাকে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতে দেওয়া হবে না।’
এই বক্তব্যের জন্য আলী হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, রিট করার জন্য তাঁকে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অধিকার আলী হোসেনের নেই। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সামিনা লুৎফা লিখেছেন, ‘তবে সেটাও হতে হবে ডিউ প্রসেসে (যথাযথ প্রক্রিয়ায়)। এটা সুশীলগিরি হলে আমি সুশীল! লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার!’
সামিনা লুৎফা ফেসবুক পোস্টে আরও লিখেছেন, ‘নিজের ছাত্রকে নিয়ে আর কী লিখব। সে সুশীলগিরি দেখাতে না করেছে, সেই সুশীলগিরিই দেখাইলাম। সে বলেছে (ওই ছাত্রীকে) যে সাপোর্ট করবে, তাদের জন্যও সে একই দাওয়াই প্রস্তাব করছে। যাঁরা আলী হোসেনের মতামতে বিশ্বাস করেন এবং সমাজবিজ্ঞান পড়েও মনে করেন যেকোনো মানুষকে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া যায় অকাতরে, তাঁরা আর আমার ক্লাসে বসার চেষ্টা করবেন না। আমি আপনাদের পড়াব না।’
আলী হোসেনকে শিবিরের কর্মী বলেছেন অনেকে। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটা বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে ডাকসুর জিএস প্রার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এসেছে, সে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত নয়। যাঁরা এটার সঙ্গে জড়িয়ে ছাত্রশিবির নিয়ে প্রোপাগান্ডা (অপপ্রচার) ছড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন তিনি।
পরে রাতে আলী হোসেনের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে প্রক্টরের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ।
‘আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংস মনোভাবের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জ্ঞাপন’ শিরোনামে জমা দেওয়া ফরহাদের ওই লিখিত আবেদনে বলা হয়, ‘আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারীর প্রতি সহিংসতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের প্রতি বুলিং, স্লাটশেমিং ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের ব্যাপারে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ রয়েছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট এ সকল অভিযোগের ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপ নিশ্চিত করে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত এবং ক্যাম্পাস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও নারী হেনস্তার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।’
সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করে রিটকারীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ সেশন ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আলী হুসেন কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করে হুমকি দেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই আবেদনে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এই ধরনের ঘটনা নারীর প্রতি অবমাননা ও সহিংসতামূলক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং এই জঘন্য অপরাধে জড়িত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের জোরালো দাবি জানাই।’
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে রিট আবেদনকারী ওই ছাত্রী বলেছিলেন, টিএসসিতে ছাত্রশিবির রাজাকারদের ছবি টাঙিয়েছিল। তাদের জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে প্রচেষ্টা ছিল, সেটি ডাকসুর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিরোধিতা করে। তাঁর এই রিট ডাকসু নির্বাচন বানচাল করার জন্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চাই ডাকসু নির্বাচন হোক। আমাদের মধ্য থেকে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তচিন্তা এবং গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি হওয়ার জন্য এই নির্বাচন হওয়াটা খুবই দরকারি।’
এই রিট করার পর থেকেই ফেসবুকে ‘বট অ্যাটাক’ এবং ‘বুলিংয়ের’ শিকার হচ্ছিলেন বলে অভিযোগ করেছিলেন ওই ছাত্রী। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ফরহাদের সাথে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধিতার জায়গা থেকে এই রিট করা হয়নি। এটি এখন আদালত থেকেই মীমাংসিত হবে। কিন্তু এই রিট করার পর থেকে আমি নানা রকম বট অ্যাকাউন্ট থেকে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছি। ডাকসু নির্বাচনে আমি আশা করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেচনা বোধসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা এমন কাউকে ভোট দেবে না, যারা নারীর প্রতি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে।’
সংশোধনী: প্রতিবেদনটি প্রথমে ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১০টা ২৭ মিনিটে প্রকাশিত হয়েছিল “শিবিরের জিএস প্রার্থীর বিরুদ্ধে রিটকারী ছাত্রীকে ‘গণধর্ষণের’ হুমকি, প্রতিবাদ–সমালোচনা” শিরোনামে। এই শিরোনাম নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে বিবেচনায় সেটি পরিবর্তন করে ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১টা ১৭ মিনিটে “রিটকারী ছাত্রীকে ‘গণধর্ষণের’ হুমকি, প্রতিবাদ–সমালোচনা” করা হলো।