।। শাহনাওয়াজ রকি।।
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনেকে আলাপ করছেন যে রাজনীতির গতিপথ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
আমার তো মনে হচ্ছে সময় আসলে আরও দেড় যুগ আগেই এসেছে, কিন্তু মোমেন্টামটা হয়তো আমাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকরা ধরতে পারেননি।
যাদের জন্ম ৯০-এর দশকে, এই জেনারেশনটা খুব বিটিকেলে একটা সময়ের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে। একেবারে অ্যানালগ একটা সিস্টেম থেকে পুরোপুরি ডিজিটাল একটা দুনিয়ার বিবর্তনের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছে তারা।
যাদের বয়স এখন, ৪০-৪৫।
কিন্তু আপনারা ৭০-৮০ বছর বয়সেও রাজনীতিতে অ্যাক্টিভ থাকবেন সে চিন্তায় ২০২৫ এসে যে ৪০+ বয়সী রাজনীতিবিদ হবে তাকে আপনি গ্রুমিং করেননি, তাদের নিয়ে মাঠের রাজনীতি গরম করে রেখেছেন।
তারাও কিছুটা ডিজিটাল, কিছুটা অ্যানালগ, আবার কিছুটা লেজুড়বৃত্তির চক্করে পড়ে পুরোপুরো ডিজিটাল জেনারেশন হয়ে উঠতে পারেনি।
এসব করতে করতেই যে আরেকটা জেনারেশন তৈরি হয়েছে সে দিকে নজর দেওয়ার সময় কই?
আপনারা তো ছিলেন ৭০-৮০ বছর বয়সেও ক্ষমতায় থাকবেন, দেশ চালাবেন সে চিন্তায়।
অথচ এই মিলেনিয়াল জেনারেশন, যারা এখন ২৫+ বয়সী তারা কিছু এখন টগবগে তরুণ। কিন্তু তারা মাঠে থাকে না, সারদিন অনলাইনে বুঁদ হয়ে থাকে। এই অনলাইনে তাকে যে কোনো সময়ে রিচ করা যায়।
তার কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাতে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় গিয়ে মাইকে চিল্লানো লাগে না।
আপনি আপনার বার্তাটা দিবেন, সে যদি নিজেকে এর সাথে কানেক্ট করতে পারে, তাহলে আপনা আপনিই সে আপনার বার্তাটা গ্রহণ করবে।
তাদের ফোর্স করা লাগে না, শুধু কানেক্ট করতে পারলেই হয়। কারণ তাদের কমিউনেকশন স্টাইল ভিন্ন, তারা শোনে বেশি বলে কম।
এরপরের জেনারেশন যারা, ১৫+ বয়সী তারা তো আরও দুর্দান্ত। তারা জানে অনলাইন শুধু কমিউনিকেশন বা সোশ্যালাইজেশনের জায়গা না।
এই জগৎ হচ্ছে মারাত্মক এক নেটওয়ার্কিংয়ের জগৎ, যেখানে আমি ভুরুঙ্গামারিতে বসে ভালো একটা আইডিয়া দিয়ে আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করতে পারি। আমি খাগড়াছড়িতে বসে ঢাকায় হাজার খানেক গ্রাহককে সেবা দিতে পারি।
এসব করা গেলে, আমি অনলাইনেই লাখ দুইয়েক সদস্যের একটা পলিটিক্যাল দলও পরিচালনা করতে পারি।
এদের সাথে সভাসমাবেশ করতে আর শাহবাগ লাগে না, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান লাগে না। লাগে শুধু তাদেরকে কানেক্ট করার মতো একটি ‘ন্যারেটিভ’
শুধু এই ন্যারেটিভটা ঠিকঠাক মতো ব্যবহার করতে পেরেছে বলেই অনলাইনেই একটা আন্দোলন সংগঠিত হয়ে অফলাইনের একটা সরকারকে ২০২৪ সালে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলেছে।
২০২৫-এ এসে নেপালেও একই কাহিনী। ঢাকসু নির্বাচনেও একই চিত্র।
অথচ সেই ৯০-এর দশকে জন্ম নেওয়া জেনারেশন, যারা সেমি-ডিজিটাল, সেমি অ্যানালগ তাদের যদি তখন গ্রুমিং করা হতো, তাহলে পরের পুরোপুরি ডিজিটাল জেনারেশনগুলোর সাথে সেতু বন্ধন হওয়ার একটা দারুণ সুযোগ থাকতো।
৭০-৮০ বছর বয়সেও ক্ষয়তার শীর্ষে থেকে ছড়ি ঘোরাবো, সে চিন্তা বাদ দিয়ে যদি পরের জেনারেশনকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন তাহলে হয়তো ব্যপারটা ভিন্ন হতো।
আফসোস করা লাগতো না যে- আমাদের সময় মুরুব্বি দেখলে রাস্তা ছেড়ে দিতাম, গাড়ি থেকে নেমে যেতাম।
কিন্তু এখনকার জেনারেশন সেটা করবে না, কারণ তারা তো রাস্তায়ই নামে না, তাদের সব কিছুই অনলাইনে, যে জগৎ আপনার পরিচিত না।
জামাতের বা শিবিরের মতো আরও কিছু রাজনৈতিক পক্ষকে যেহেতু মাঠে রাজনীতি করতে দেওয়া হয়নি, ফলে তারা অনলাইনের এই জগৎকে এক্সপ্লোর করেছে, হয়তো বাধ্য হয়েই করেছে।
তার ফলটা হয়তো দেখা গেছে এই ডাকসু নির্বাচনে, কারণ এখানেই আপনার সেই মিলেনিয়াল আর জেনজিরা ভোটার।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে হয়তো ঢাকসুর মতো চিত্র দেখা যাবে না, কারণ এখনও তো ৪০-৮০ বয়সীরা ভোট দিবেন, কিন্তু আরও কয়েকটা নির্বাচন পরে কিন্তু আপনাদের গতানুগতিক ন্যারেটিভ আর ধোপে টিকবে না।
একই ভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্লক করে দিয়েছে বলেই নেপালের তরুণরা ক্ষমতা ছাড়া করেছে সরকারকে। কারণ এটাই তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা বলতে গেলে এখানেই খায় আর ঘুমায়।
সেখানে হাত দেয়ার কারণেই হয়তো হয়তো এ নেপালের কিছু ভিডিওতে দেখছিলাম- বুড়ো রাজনীতিবিদদের পিচ্চি পিচ্চি পোলাপাইন মিলে পিঠাচ্ছে।
কারণ একসময় আপনাদের রাস্তা ছেড়ে দিতে হতো, এখন রাস্তায়ই আপনাদের ছেড়ে দিচ্ছে। কারণ পরের প্রজন্মের জন্য আপনারা রাস্তা চিনিয়ে দেয়ার ন্যারেটিভ তৈরি করেননি।