বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার হাওর অঞ্চল আজ এক অভূতপূর্ব হুমকির সম্মুখীন। সুনামগঞ্জে প্রস্তাবিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দেখার হাওরের ১২৫ একর জমি ভরাট করার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিষয় নয়। এটি আমাদের হাজার বছরের পুরনো জীববৈচিত্র্য, কৃষি ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের বিরুদ্ধে এক ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ।
দেখার হাওর সুনামগঞ্জের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাওর হিসেবে শুধু একটি ভৌগোলিক এলাকা নয়। এটি একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র যা বছরের সাত মাস পানিতে নিমজ্জিত থেকে অগণিত প্রাণীর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। শুষ্ক মৌসুমে এখানকার উর্বর মাটিতে ফলে বোরো ধানের সোনালি ফসল, যা স্থানীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বর্ষায় এই একই জায়গা হয়ে ওঠে মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। কিন্তু আজ এই অমূল্য সম্পদের উপর কুড়াল চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে উন্নয়নের নামে।
হাওর অঞ্চলের পরিবেশগত গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে যে এগুলো শুধু জলাভূমি নয়, বরং একটি জটিল হাইড্রোলজিক্যাল সিস্টেম। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় থেকে আসা পানি এই হাওরগুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নদীগুলোতে মিশে যায়। এই প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ ব্যবস্থা যদি কোথাও বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়ে সমগ্র অঞ্চলের উপর।
বুয়েটের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের হাওরের আয়তন কমেছে ৮৭ শতাংশ। ৩০৩৪ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে হয়েছে মাত্র ৪০৬ বর্গকিলোমিটার। এই পরিসংখ্যান আমাদের সামনে তুলে ধরে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ হারিয়ে ফেলছি অভূতপূর্ব গতিতে। এমন একটি সময়ে যখন আমাদের উচিত অবশিষ্ট হাওরগুলোকে রক্ষা করা, তখন আমরা আরও ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছি।
সুনামগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যে জায়গাটি নির্বাচন করা হয়েছে, সেটি বর্তমানে বছরের সাত মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। কোনো কোনো জায়গায় পানির গভীরতা পাঁচ ফুট পর্যন্ত। এই জমি ভরাট করতে প্রয়োজন হবে বিশাল পরিমাণ মাটি। এই মাটি আসবে কোথা থেকে? স্থানীয় উৎস থেকে মাটি সংগ্রহ করা হলে তা আরও পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হবে। আর বাইরে থেকে মাটি আনতে গেলে খরচ হবে অকল্পনীয়।
কিন্তু মূল সমস্যা খরচের নয়, পরিবেশের। একটি হাওরের মধ্যে ১২৫ একর জমি ভরাট করার মানে হলো সেই এলাকার প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ ব্যাহত করা। নাইন্দা নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক চলাচলে সমস্যা দেখা দেবে। ফলে একদিকে যেমন বন্যার ঝুঁকি বাড়বে, অন্যদিকে মাছের প্রজনন ক্ষেত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেখানে গড়ে উঠবে একটি পূর্ণাঙ্গ জনপদ। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের জন্য প্রয়োজন হবে আবাসিক এলাকা। গড়ে উঠবে দোকানপাট, বাজার, রেস্টুরেন্ট। এই সব কিছুর জন্য আরও জমি ভরাট করতে হবে। আর একবার এই প্রক্রিয়া শুরু হলে তা বন্ধ করা খুবই কঠিন। একে একে পুরো হাওর এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্থানীয় জনগণ। যাদের জীবিকা নির্ভর করে হাওরের উপর, যারা এখানে মাছ ধরে, ধান চাষ করে জীবন চালায়, তাদের জীবনে নেমে আসবে বিপর্যয়। হাওরের পানিতে মাছের পরিমাণ কমে যাবে। উর্বর জমি হারিয়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে।
শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সুনামগঞ্জের মতো একটি অনগ্রসর জেলায় একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আমরা কেন আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করব? জেলার মধ্যে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যায়। স্থানীয় জনগণ লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের জুগিরগাঁও, গৌরারং ইউনিয়নের রতনশ্রী এলাকা ও সুনামগঞ্জ পৌরসভার হাসননগরের পার্শ্ববর্তী এলাকার মতো বিকল্প স্থান প্রস্তাব করেছেন। এসব এলাকা উঁচু ভূমিতে অবস্থিত এবং কোনো প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংস না করেই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব।
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান স্বীকার করেছেন যে এই স্থান নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইউজিসি হাওর ও জলাভূমি রক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এগুলো অধিগ্রহণে নিরুৎসাহিত করার নির্দেশনা দিয়েছে। তাহলে কেন এই প্রকল্প এগিয়ে যাচ্ছে?
হাওর অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা শুধু স্থানীয় একটি বিষয় নয়। এটি জাতীয় স্বার্থের সাথে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে জলাভূমিগুলো আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। এগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে, কার্বন শোষণ করে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। একবার এই বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেলে তা আর ফেরানো সম্ভব নয়।
শিক্ষা ও পরিবেশ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটির জন্য অন্যটিকে বিসর্জন দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হোক, তবে তা হোক এমন একটি স্থানে যা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি না করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন মানে ধ্বংস নয়। টেকসই উন্নয়ন মানে হলো এমন উন্নয়ন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে। হাওরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের এই পরিকল্পনা টেকসই উন্নয়নের পরিপন্থী। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে তাদের প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার কেড়ে নেওয়ার শামিল।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। হাওর অঞ্চলের এই অমূল্য সম্পদ আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য। এটি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। সুনামগঞ্জের মানুষ যে দাবি তুলেছে, তা ন্যায্য ও যুক্তিসংগত। তাদের এই দাবি মেনে নিয়ে বিকল্প স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
হাওর শুধু পানি আর মাছের ভাণ্ডার নয়। এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ, আমাদের ঐতিহ্যের ধারক। হাজার বছর ধরে এই হাওরগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সভ্যতা। আজ যদি আমরা এই সম্পদ রক্ষা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। তারা প্রশ্ন করবে, কেন আমরা তাদের জন্য একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবী রেখে গেলাম?