।। আখতারুজ্জামান আজাদ ।।
এরশাদের আমলে সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধান বিচারপতি। এরশাদের পতনের পর সবগুলো রাজনৈতিক দল সাহাবুদ্দীনকে অনুরোধ করেছিল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এবং একটা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য। রাষ্ট্রপতি হতে সাহাবুদ্দীন প্রথমে রাজিই হননি। সব দলের মুহুর্মুহু অনুরোধে তিনি রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু শর্ত দিয়েছিলেন যে, প্রধান বিচারপতি হিশেবে তার যতটুকু মেয়াদ বাকি থাকবে, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায়ের পর প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গিয়ে ঐটুকু মেয়াদ পূরণ করার সুযোগ তাকে দিতে হবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির পদ থেকে একবার বিদায় হয়ে আবার ফিরে আসার সু্যোগ বাংলাদেশের সংবিধানে নেই। সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্য শেষ পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে তিনি প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গিয়েছিলেন।
২০১৩ সালে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের মূল দাবি ছিল ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ যে আপিল করতে পারে না, সেই আইন পরিবর্তন করা। সরকার আইন পরিবর্তন করেছিল। গণজাগরণ মঞ্চের উচিত ছিল তখনই, মানে আইন পরিবর্তনের দাবি পূরণ হওয়ার সাথে-সাথে, শাহবাগ থেকে বিদায় হওয়া। কিন্তু মঞ্চের মুখপাত্ররা ততদিনে মজা পেয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ করে পাদপ্রদীপের আলোয় এসে তারা আর সাধারণ জীবনে ফিরে যাননি। মুখপাত্র ইমরান হোসেন সরকার ডাক্তারি পেশা ত্যাগ করে পেশাদার মুখপাত্র হয়ে গিয়েছিলেন, সাময়িক জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, ২০১৮-এর নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিশেবে নির্বাচন করে যথারীতি জামানত হারিয়েছিলেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন শাহবাগে যত লোক আন্দোলনে গিয়েছিল, সবাই তার কর্মী। মুখপাত্র আর তার সহচরদের অতি-লোভের কারণে গণজাগরণ মঞ্চ এখন হাসির পাত্র। মুখপাত্র গং বুঝতে পারেনি কখন কোথায় থামতে হয়। থামতে না-শেখার কারণে কালের গর্ভ থেকে তারা হারিয়ে গেছেন।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সমন্বয়কদেরও এখন থামার সময় হয়েছে। ৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের ভূমিকা জাতি শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখবে। তাদের মধ্য থেকে দুজনকে মন্ত্রিত্বও দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী এক-দেড় মাসে তাদের বিরুদ্ধে ত্রাণের অর্থ আত্মসাতের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠেছে, নারীকেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে, উঠেছে আইনবহির্ভূত আরো নানান কর্মকাণ্ডের শক্তিশালী অভিযোগ। আওয়ামি লিগ ও বিএনপির স্বৈরাচারী মন্ত্রী-সাংসদরা যা যা করে গেছেন, সমন্বয়করা হুবহু তা-ই করে চলছেন বা করার চেষ্টা করছেন। তারা যে-জেলায়ই যাচ্ছেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ধাওয়া খেয়ে ফিরছেন, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে ব্যবহার করছেন পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে। অল্প কয়েকজনকে বাদ দিলে দেড় শতাধিক সমন্বয়কের সবাই শিক্ষার্থী। এখন তাদের কাজ হলো সচিবালয়ে ভিড় না-করে নিজ-নিজ শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়া এবং তারকা হওয়ার চেষ্টা বা আন্দোলনকে ব্যবহার করে পয়সা রোজগারের চেষ্টা না-করে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া। সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে স্বপদে ফিরে গিয়েছিলেন। সমন্বয়করা সাহাবুদ্দীন আহমদের চেয়ে বড় কেউ না। তাদেরকে দ্রুত শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে হবে। নইলে ইমরান হোসেনের মতো অপ্রাসঙ্গিক ও অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যেতে হবে। ইমরান অন্তত অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সমন্বয়কদের অধিকাংশের ভাগ্যেই জীবনে একবারও উড়োজাহাজে চড়ার সুযোগ আসবে না। বাগে পেলে আওয়ামি লিগ এই সমন্বয়কদেরকে নিশ্চিহ্ন করে তো ফেলবেই, আর মাস কয়েক পর বিএনপি-জামায়াতও সমন্বয়ক-নিধন শুরু করে দেবে। আমির-এ-জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বা ভারপ্রাপ্ত আমির-এ-জাতীয়তাবাদ তারেক রহমানকে এখন যতটা মিষ্টিমধুর রূপে দেখা যাচ্ছে, মাস কয়েক পরই তাদের ভিন্নরূপ দেখা যাবে। তখন সমন্বয়কদের পশ্চাৎপ্রদেশের এক বর্গইঞ্চি চামড়াও অক্ষত থাকবে না। টিএসসি থেকে ছাত্ররা এসে তখন সেই ক্ষতবিক্ষত চামড়া মেরামত করে দিয়ে যাবে না। কেননা, সব ছাত্র সমন্বয়কদের কর্মী না, ততদিনে সবার মোহভঙ্গও হয়ে যাবে।
সমন্বয়কদের উচিত হবে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ব্যারাকে ফিরে যাওয়া। জুলাইয়ের সমন্বয়করা এই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক, নিষ্প্রয়োজন এবং ক্ষেত্রবিশেষে উৎপাত।