বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান, নদীমাতৃক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ তাকে একসময় দক্ষিণ এশিয়ার নৌ-উদ্যোক্তা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। বিশেষ করে ১৬শ থেকে ১৮শ শতক পর্যন্ত বঙ্গ ছিল এশিয়া ও ইউরোপীয় বণিকদের জাহাজ ক্রয় ও মেরামতের অন্যতম গন্তব্য।
১. জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্রসমূহ
• চট্টগ্রাম: “Shipbuilding hub of Bengal” নামে পরিচিত ছিল। এখানে তৈরি জাহাজ ইউরোপীয় বাজারেও বিক্রি হতো।
• সোনারগাঁও, গৌড়, বিক্রমপুর, বরিশাল, নরসিংদী: অভ্যন্তরীণ নৌযান থেকে শুরু করে সমুদ্রযাত্রার জন্য উপযোগী বড় জাহাজ নির্মিত হত।
• সুন্দরবনের কাঠ: গরান, সুন্দরী, সেগুন, মহগনি প্রভৃতি কাঠ ছিল অত্যন্ত টেকসই এবং সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে সহজে নষ্ট হতো না।
২. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভূমিকা
• আরব ও তুর্কিদের সাথে বাণিজ্য: ১০ম শতক থেকেই বঙ্গ অঞ্চলের জাহাজ আরব ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করত।
• চীনের সাথে সম্পর্ক: মিং রাজবংশের (১৫শ শতক) সময় বাংলার তুলা, সিল্ক ও মসলার বাণিজ্যে জাহাজ ব্যবহৃত হত।
• ইউরোপীয়দের স্বীকৃতি: ১৭শ শতকে ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসি ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পর্যন্ত বাংলার জাহাজ কিনত।
• মুঘল নৌবাহিনী: বাংলার তৈরি যুদ্ধজাহাজ সরাসরি মুঘল সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত হতো।
৩. প্রযুক্তি ও মান
• বাংলার জাহাজ ছিল সস্তা, দ্রুত নির্মিত এবং দীর্ঘস্থায়ী।
• ১০০ টন থেকে শুরু করে প্রায় ৮০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ নির্মাণ হতো।
• ইংরেজ ইতিহাসবিদ জেমস বাসে লিখেছেন, “Bengal-built ships last longer and cost half as much as European ships.”
• বাংলার কারিগররা এমন কাঠামো বানাতেন যাতে জাহাজ দীর্ঘদিন মেরামত ছাড়াই চলতে পারত।
৪. বৃটিশদের আগমনের পর পতনের কারণ
• বাণিজ্যে আধিপত্য: ১৮শ শতকের শেষভাগে ইংরেজরা ইউরোপীয় বাজারকে দখল করে নেয়।
• নীতি ও আইন: বৃটিশরা একাধিক আইন করে যাতে ভারতীয় জাহাজ ইউরোপে বিক্রি হতে না পারে।
• কর চাপানো: স্থানীয় শিল্পে অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়, অথচ ইউরোপীয় জাহাজে শুল্ক কমানো হয়।
• জাহাজ আমদানির বাধ্যবাধকতা: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে বৃটিশ নৌবাহিনী ভারতীয় নয়, শুধু ইউরোপীয় জাহাজ ব্যবহার শুরু করে।
• কারিগরদের অবক্ষয়: একসময়ের দক্ষ জাহাজ নির্মাতারা কাজ হারিয়ে কৃষি বা শ্রমজীবী জীবনে চলে যায়।
৫. ঐতিহাসিক স্বীকৃতি
• ১৮০১ সালে চট্টগ্রামে তৈরি “HMS Asia” নামের যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে ব্যবহার হয়।
• বাংলার তৈরি জাহাজের আয়ুষ্কাল ইউরোপীয় জাহাজের দ্বিগুণ ছিল বলে নথিভুক্ত আছে।
• অনেক ইউরোপীয় নৌ-ইতিহাসবিদ বাংলার জাহাজশিল্পকে বিশ্বের অন্যতম টেকসই শিল্প বলে অভিহিত করেছেন।
আজকের দিনে, যদি সরকার এবং বেসরকারি খাত আবার উদ্যোগ নেয়, তাহলে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে আধুনিক শিপবিল্ডিং শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।